ঢাকা, ২৬ নভেম্বর, ২০২৪
সর্বশেষ:

সালমান শাহ’র রহস্যজনক মৃত্যুর ২০ বছর: তদন্তে এবার পিবিআই

স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশিত: ০২:৪৩, ৮ ডিসেম্বর ২০১৬   আপডেট: ০২:৩৯, ৯ ডিসেম্বর ২০১৬

সংবাদ (১৫ মে)  সম্মেলনে নীলা চৌধুরী বক্তব্য রাখেন   -ফাইল ফটো

সংবাদ (১৫ মে) সম্মেলনে নীলা চৌধুরী বক্তব্য রাখেন -ফাইল ফটো

ঢাকা: নায়ক সালমান শাহের (চৌধুরী মো. ইমন) রহস্যজনক মৃত্যুর ২০ বছর পর আরেকবার ওই ঘটনা তদন্ত শুরু হতে যাচ্ছে। তবে এবার তদন্তে নামছে বিশেষ ধরনের অপরাধ তদন্তে গঠিত পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।

প্রসঙ্গত, নায়ক রাজ রাজ্জাক থেকে নিয়ে ইলিয়াস কাঞ্চন যুগের পরবর্তী প্রজন্মে বাংলাদেশি চিত্রনায়কদের মধ্যে সবচেয়ে দর্শকপ্রিয়তাধন্য নায়ক সালমান শাহর মৃত্যুর ঘটনা অনকে রহস্যময়তায় আবৃত। এ ঘটনা জনমনে টানা দুই যুগ ধরে অনেক প্রশ্নের খোরাক যুগিয়েছে। সবশেষে এলিট ফোর্স র‌্যাবকে দিয়ে এ ঘটনা পুনঃতদন্তের আদেশ আটকে যায়। তবে এবার সে দায়িত্ব পেয়েছে পিবিআই।

১৯৯৬ সালে দেশ তোলপাড় করা ওই ঘটনার পর সালমানের মা নীলা চৌধুরী ১১ জনকে তার ছেলের মৃত্যুর জন্য দায়ী করেন। তাদের মধ্যে আছেন সালমানের স্ত্রী সামিরা হক, চলচ্চিত্র প্রযোজক ও ব্যবসায়ী এবং বিভিন্ন ঘটনায় আলোচিত-বিতর্কিত আজিজ মোহাম্মাদ ভাই।

এদিকে, ৬ ডিসেম্বর ঢাকা মহানগর হাকিম লস্কর সোহেল রানা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনকে (পিবিআইকে) দিয়ে পুনরায় আলোচিত মামলাটির তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।

গত মঙ্গলবার আদালত এই আদেশ দেয়। তবে তা সাধারণ্যে জানাজানি হয় বুধবার।

এতদিন পর এই আদেশে কিছুটা আশাবাদী মামলার বাদী একসময়ের জাতীয় পার্টির আলোচিত নেত্রী সালমানের মা নীলা চৌধুরী।

‘পুত্র হত্যা’ মামলার নয়া এই মোড় সম্পর্কে নীলা চৌধুরী সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, এ আদেশটি অসীম অন্ধকারে আমাদের কাছে একবিন্দু আলো মতো। ভেবেছিলাম কেউ আমাদের বিষয়টি বিচারিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে না দেখে আমাদের ন্যায্য দাবি থেকে বার বার দূরে ঠেলে দিচ্ছে।

নীলা চৌধুরীর আইনজীবী মাহফুজ মিয়া বলেন, দেখা যাক এখন সালমান শাহর হত্যার তদন্ত কোন পথে যায়।

এর আগে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের একজন বিচারক র্যা কে দিয়ে মামলাটির অধিকতর তদন্তের আদেশ দেয়। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষ দায়রা জজ আদালতে গেলে তা আটকে যায়।

এ ঘটনায় সালমান শাহর মা নীলা চৌধুরী অভিযোগ করেছিলেন, আসামি পক্ষের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ‘রাষ্ট্র নিজেই রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অবস্থান’ নিয়েছে।

এই মামলাটির বাদী ছিলেন সালমানের বাবা কমর উদ্দিন। তিনি মারা যাওয়ার নীলা বাদী হিসেবে পরিগণিত হন। তিনি আগের তদন্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে নারাজি আবেদন করেন।

তবে এ প্রসঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী পিপি আবদুল্লাহ আবু বলেছিলেন, নীলা চৌধুরী এই মামলার বাদী নন। তাই তিনি বাদী হিসেবে নারাজি দিতে পারেন না।

পিপি আবদুল্লাহ বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে নীলার আইনজীবী মাহফুজ মিয়া বলেন, সালমানের বাবা মারা যাওয়ার পর আদালতের নির্দেশে করা বিচার বিভাগীয় তদন্ত প্রতিবেদন বিপক্ষে গেলে মৃতের মা নীলা চৌধুরী স্বার্থ সংশ্লিষ্ট পক্ষ হিসেবে নারাজি দিয়েছিলেন।

উল্লেখ্য, দেশীয় সিনেমায় জনপ্রিয়তার শিখরে থাকা অবস্থায় ১৯৯৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর রাজধানীর ইস্কাটন রোডে নিজের বাসস্থান থেকে নায়ক সালমান শাহর লাশ উদ্ধার করা হয়। দেশজুড়ে সালমান ভক্তরা আদালতে বেশ কয়েকবার বিক্ষোভও দেখায় ‘সালমান হত্যা’র বিচার দাবি করে।

ওই সময়ের চাঞ্চল্যকর এ ঘটনাটি আত্মহত্যা বিবেচনায় পুলিশ অপমৃত্যুর মামলা করে। তবে তাতে আপত্তি জানায় ইমনের পরিবার। এরপর সালমানের বাবা হত্যা মামলা করেন।

নীলা চৌধুরী বলেন, তার (ইমন অর্থাৎ সালমান শাহ) লাশ ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া যায়নি। অথচ আসামিপক্ষ বলে আসছে যে লাশ ঝুলন্ত অবস্থায় পাওয়া গেছে।

এ ঘটনায় নীলা চৌধুরী পুত্রবধূ সামিরা হক ও আজিজ মোহাম্মাদ ভাই ছাড়াও অন্য যাদের দায়ী করেন তারা হলেন- সামিরার মা লতিফা হক লুসি, রিজভী আহমেদ ওরফে ফরহাদ, সহকারী নৃত্যপরিচালক নজরুল শেখ, ডেভিড, আশরাফুল হক ডন, রাবেয়া সুলতানা রুবি, মোস্তাক ওয়াইদ, আবুল হোসেন খান ও গৃহকর্মী মনোয়ারা বেগম।

ঘটনার পর দীর্ঘ ধারাবাহিকতায় বেশ কয়েকবার একে ‘আত্মহত্যা’ বলে আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়। কিন্তু প্রতিবারই সালমানের পরিবার পুনঃতদন্ত চেয়ে আসছে।

২০ বছর পর এই বছরের জানুয়ারিতে এই মৃত্যুর ঘটনা হত্যা না আত্মহত্যা, তা নির্ধারণে মামলাটি আবার আদালতে ওঠে।

‘সালমানকে হত্যা করা হয়েছিল’ দাবি করে নীলা চৌধুরীর আইনজীবীদের অন্যতম ফারুক বলেন, আসামি রিজভী আহমেদ এর আগে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে হত্যার কথা বলেছিলেন।

তিনি আরও বলেন, সালমান হত্যায় অন্য আসামিদের সাহায্য করার জন্য রিজভী সালমানের পা চেপে রেখেছিলেন। সালমানের স্ত্রী সামিরা, সামিরার মা, ডন, আজিজ মোহাম্মদ ভাইকে সম্পৃক্ত করে অন্য একটি মামলায় সালমানের হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে রিজভী এই জবানবন্দি দেন একজন হাকিমের কাছে। এই মামলার শুনানিতেও তা তুলে ধরা হয়েছে।”

মে মাসে নীলা চৌধুরী সাংবাদিক সম্মেলনে যা বলেন
চলতি বছরের ১৫ মে সালমানের (ইমন) মা নীলা চৌধুরী ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে এক সংবাদ সম্মেলন করেন। এতে তিনি তার পুত্রহত্যার জন্য পুত্রবধূর পরকীয়াকে দায়ি করে বক্তব্য দেন। তিনি ‘সালমান শাহ হত্যা’র রহস্য উদঘাটনে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

ওই সংভাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে পুত্রের খুনের বিচার নিয়ে টালবাহানার বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে নীলা চৌধুরী বলেন, কষ্টে আমার বুক ফেটে যায়! গেল ৯ মাসে ১১ বার শুনানির পরও আমার ছেলের মামালার রায় প্রকাশ করা হয়নি।

ছেলের মৃত্যুকে ‘পরিকল্পিত খুন’ দাবি করে নীলা চৌধুরী বলেন, সালমানের শরীরে কোনো ক্ষত চিহ্ন ছিলো না যাকে আত্মহত্যা বলা যায়। খালি ইঞ্জেকশন পুশ করে এবং জেসকিন ইঞ্জেকশন দিয়ে, গলায় চাপ দিয়ে শ্বাসরোধ করে তাকে হত্যা করা হয়েছিলো। সেই প্রমাণ পুলিশ ঘটনার পরপরই পেয়েছিলো। কিন্তু আজ সব উধাও হয়ে গেছে!

এসময় সাংবাদিকরা প্রশ্ন করেন, প্রমাণ কেন উধাও হয়েছে বলে আপনি মনে করেন? জবাবে নীলা চৌধুরী বলেন, সালমানের স্ত্রী সামিরার পরকীয়া সম্পর্ক এবং চলচ্চিত্রের সিন্ডিকেটের কারণেই আমার ছেলেকে খুন হতে হয়েছে। যারা এই পরিকল্পনায় জড়িত ছিলেন তারাই সব উধাও করিয়েছেন।

সালমানের মৃত্যুতে স্ত্রী সামিরাকে দায়ী করে সালমানের মা তখন আরও বলেন, ‌সালমান শাহ’র মৃত্যুর পর স্ত্রী সামিরা ও তার পরিবারকে আমার পাশে কোনো সময় দাঁড়াতে দেখিনি। স্বামী হারানোর কোনো কষ্টও দেখিনি তার মধ্যে। তাছাড়া সামিরা এখন সালমান শাহ’র এক বন্ধুর স্ত্রী হিসেবে ঘর-সংসার করছে। এটা কি প্রমাণ করে না যে সামিরার পরকীয়া সম্পর্ক ছিলো? এই পরকীয়ার বলি হলো আমার ছেলে।

তিনি আরো বলেন, ‘একজন মা হিসেবে ছেলে হারানোর শোক আমি কাকে বুঝাবো? আমি কিছু চাইনি। শুধু আশা করেছিলাম চলচ্চিত্রাঙ্গন সালমানের খুনের বিচারে সোচ্চার হবে। আশা করেছিলাম, রাষ্ট্র এই হতভাগী মাকে তার সন্তান খুনের বিচার করে দেবে। আমি তা পাইনি।

তিনি এ বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করে বলেন, এই দেশে আইনের সুশাসনের বহু নজির আছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে দেশে এক বিরল ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। আমি এই বরেণ্য দেশনেত্রীর কাছে একজন মা হিসেবে সন্তান খুনের বিচার চাইছি। আপনি একজন মা, এই অভাগী মাকে তার ন্যায় বিচার দিন। সালমান খুনের যে বিচার দীর্ঘদিন ধরে টালবাহানার শিকার হচ্ছে আপনি এর প্রতি নজর দিন।

নীলা আরও বলেন, বিশ বছর পেরিয়ে যাচ্ছে এখনো দেশের বহুল আলোচিত এই খুনের বিচার হলো না। একটি খুনকে শুরু থেকেই ধামাচাপা দেওয়ার জন্য সিআইডি ও বিচার বিভাগীয় তদন্তে অপমৃত্যু উল্লেখ করে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। এটি কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না।

পাল্টা অভিযোগ

তবে নীলা চৌধুরীর দাবির পিরীতে আসামিদের পক্ষ নিয়েও সামাজিক মাধ্যমে পাল্টা অভিযোগ আনা হয় তার বিরুদ্ধে। এ্ পক্ষের দাবি- আজির মোহাম্মদ ভাইয়ের সঙ্গে মা নীলা চৌধুরীর সম্পর্ক ও চালচলনে ক্ষুব্ধ হয়ে সালমান শাহ আত্মহত্যা করেন। চিত্রনায়কা শাবনূরের সঙ্গে সালমানের সম্পর্কের সূত্রে নিজের দাম্পত্য জীভনে অশান্তির কারণও সালমানকে আত্মহত্যায় উদ্ধুব্ধ করেছে বলে দাবি করে এই পক্ষটি। তবে নীলা চৌধুরীর পাল্টা অভিযোগ- তার পুত্রবধূর সঙ্গে আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের অনৈতিক সম্পর্ক ছিল।

এখন দেখা যাক- পিআইবি’র তদন্ত এই জটিল এবং আলোচিত মামলায় নয়া কোনো আলোকপাত করতে পোরে কি না! দেশ-বিদেশে লাখো সালমান শাহ ভক্ত এবং মামলার পক্ষ-বিপক্ষের সবাই এখন থেকে পিআইবির দিকে তাকিয়ে থাকবে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া পর্যন্ত।

নিউজওয়ান২৪.কম/এসএমএম