ঢাকা, ০৪ ডিসেম্বর, ২০২৪
সর্বশেষ:

প্রকৃত রাসূল (সা.) প্রেমিকের অনুপম নিদর্শন

ধর্ম ডেস্ক

প্রকাশিত: ০৮:২৯, ১১ নভেম্বর ২০১৯  

ফাইল ফটো

ফাইল ফটো

প্রিয় নবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদর্শ মোতাবেক প্রতিটি ইবাদত পালন একজন নবীপ্রেমিক বান্দার একান্ত কাম্য হওয়া উচিত।

মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেছেন, ‘যারা আল্লাহ ও শেষ দিনের আশা রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে, তাদের জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর মধ্যে উত্তম নমুনা রয়েছে’। (সূরা: আল আহযাব, আয়াত: ২১)।

সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট মহামানব রাসূল (সা.)। তাঁর প্রতি ঈমান আনা ও তাকে সবকিছুর চাইতে বেশি ভালবাসা একজন মুমিনের একান্ত কর্তব্য। একজন প্রকৃত রাসূল (সা.) প্রেমিকের অন্তর তার প্রিয় ব্যক্তির জন্য নিজ জান-মাল কোরবান করার জন্য অস্থির হয়ে যায়। প্রকৃত নবীপ্রেমীদের অবস্থা এ থেকে আলাদা নয়। 

সাহাবাগণ তাঁর জন্য সব কিছু উৎসর্গ করে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করেছেন। নবীজীর (সা.) মৃত্যুর পর তাঁর সত্য অনুরাগীরা নিজেদের অন্তরে এ বলে পরিতাপ করেন যে, তারা তাঁর জন্য নিজেদের জান-মাল উৎসর্গ করার সৌভাগ্য থেকে বিরত রয়ে যাচ্ছে। প্রকৃত মুমিন হতে হলে পিতা-মাতা, ভাই-বোন, সন্তান-সন্ততি অর্থাৎ-দুনিয়ার সবকিছুর চেয়ে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলকেই ভালবাসতে হবে। রাসূল (সা.)-কে ভালোবাসা ঈমানের অন্তর্ভুক্ত।

হাদিসে আছে- আবূ হুরায়রা (রা) থেকে বর্ণিত। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘ওই সত্তার শপথ যার হাতে আমার প্রাণ। তোমাদের কেউ ততক্ষণ পর্যন্ত প্রকৃত মু‘মিন হবে না যতক্ষণ পর্যন্ত আমি তার নিকট তার বাবা-মা তার সন্তানাদি হতে অধিক প্রিয় না হই।’ (১০৬-সহীহ বুখারী-হা: ১৪)।

একই মর্মে তিনি অন্যত্র বলেন, আনাস (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন ,নবী (সা.) বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে কেউ প্রকৃত ঈমানদার হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত আমি তার নিকট তার বাবা-মা, সন্তান-সন্ততি এবং সব মানুষ অপেক্ষা অধিক প্রিয় না হই।’(১০৭ সহীহ বুখারী,হা: ১৫)।

এখানে মুহাব্বত বা ভালবাসা সেচ্ছাকৃত অর্থে বুঝানো হয়েছে, স্বাভাবিক অর্থে নয়। ইমাম নবী (রা) বরেছেন, এখানে ‘নফসে আম্মারা’এবং ‘নফসে মুতমায়িন্না’ এর প্রতিক্রিয়ার দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে। বস্তুত: নফসে মুতমায়িন্নার প্রভাবে প্রভাবিত ব্যক্তির স্বাভাবিক ভালবাসাই রাসূলুল্লাহ (সা.) এর প্রতি অগ্রাধিকার লাভ করবে, আর নফসে আম্মার প্রভাবে প্রভাবিত ব্যক্তির স্বেচ্ছাকৃত ভালবাসাই রাসূলুল্লাহ (সা.) এর প্রতি অগ্রাধিকার পাবে-স্বাভাবিক ভালবাসা নয়। অনুরুপ ভালবাসা বাস্তবরুপ পরিগ্রহ করতে পারে রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সুন্নতের সাহায্য-সহযোগিতা, তাঁর শরিয়তের পাবন্দী এবং বিরুদ্ধ বাদীদের ভ্রান্তিপূর্ণ মতবাদের মূলোৎপাটনের মধ্য দিয়ে। সৎকাজের নির্দেশ দান এবং অসৎকাজ থেকে বাধা প্রদানও অনুরুপ ভালবাসারই পর্যায়ভুক্ত।

আল্লাহ তায়ালা এবং তাঁর রাসূলকে ভালবাসলে ঈমানের প্রকৃত স্বাদ পাওয়া যায়। হাদিসে এসেছে- আনাস ইবনু (রা) থেকে বর্ণিত। নবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘এ তিনটি গুণ যার মধ্যে বিদ্যমান সে ঈমানের মজা পেয়েছে-১.যার কাছে সকল জিনিস হতে স্বয়ং আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.) অধিক প্রিয়, ২.যে কাউকে শুধুমাত্র মহান আল্লাহর জন্যই ভালবাসে, ৩.ঈমান গ্রহণের পর আবার কুফরীর মতে ফিরে যাওয়াকে এমনভাবে অপছন্দ করে, যেমন -সে আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়াকে অপছন্দ করে। (সহীহুল বুখারী, হা: ১৬)।

এ সম্পর্কে হাদিসে অন্যত্র বলা হয়েছে- ‘আব্দুল্লাহ ইবনু হিশাম (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেন, একদিন আমরা রাসূল (সা.) এর সঙ্গে ছিলাম, তিনি ‘উমার (রা) এর হাত ধরেছিলেন। এমতাবস্থায় ‘উমার (রা) বলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমার জীবন ব্যতীত
সকল বস্তুর চেয়ে আপনি অবশ্য আমার কাছে প্রিয়। রাসূল (সা.) বলেন, না। সে সত্তার কসম যার হাতে আমার জীবন, যতক্ষণ না আমি তোমার জীবন থেকেও প্রিয় হব ততক্ষণ তুমি পূর্ণ মু‘মিন হতে পারবে না।

‘উমর (রা) বলেন, নিশ্চই এখন আপনি আমার জীবন থেকেও অধিক প্রিয়। তিনি বলেন, এখন হয়েছে, হে‘উমর!’ (সহীহ বুখারী, হা: ৬৬৩২)।

‘সে সত্তার কসম, যার হাতে আমার জীবন! যতক্ষণ না আমি তোমার জীবনের চেয়ে তোমার কাছে অধিক প্রিয় হব’-এ অংশের ব্যাখ্যায় আল্লামা আইনী বলেছেন, ‘তোমার ঈমান ততক্ষণ পরিপূর্ণ হবে না যতক্ষণ না আমি তোমার জীবনের চেয়েও অধিক প্রিয় হব।

আল্লামা আইনী আরো বলেন, ‘এখন তোমার ঈমান পরিপূর্ণ হলো, হে‘উমার! এ হাদিসে একটি কথা অনুধাবন করা উচিত যে, রাসূল (সা.) সত্যবাদী ও আমানতদার হয়েও কসম করে বলেন, ঈমানের পূর্ণতার জন্য মু‘মিনকে নিজেদের জীবনের চেয়েও তাঁকে ভালবাসা অবশ্য কর্তব্য। অথচ তিনি সত্য ও সততার এমন অধিকারী যে, তিনি কসম খান বা না খান তাঁর সমস্ত কথা সত্য এবং সন্দেহমুক্ত। এরপরও যদি তিনি কোনো কথা কসম খেয়ে বলেন, তাহলে সেটি কত সুনিশ্চিত? কেননা, কসম কোনো কথাকে সুদৃঢ় করে এটি আমরা সকলেই জানি। (উমদাতুল কারী-২৩/১৬৯)।

মদিনা ওলিতে-গরিতে মদের স্রোত: নবীপ্রেমিকদের প্রিয় বস্তু নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছে কেবল তাই তারা বর্জন করেছেন, কথা এখানে শেষ নয়; বরং তারা যে সব কাজ করতে বছরের পর বছর অভ্যস্ত, পূর্ব পুরুষদের মাধ্যমে প্রাপ্ত  তাও বর্জন করেছেন। তারা রাসূর (সা.) এর বিরুদ্ধাচারণে কোনো প্রথা বা বাপ-দাদাদের দোহাই দেননি, যা বর্তমানে অনেকে করে থাকে। এর প্রমাণে সহীহ বুখারী’র হাদীস-

আনাস (রা) কর্তৃক বর্ণিত। তিনি বলেন,আমি আবূ ত্বালহার বাড়িতে লোকদের মদ পান করাচ্ছিলাম, সে দিন ‘ফাযীখ’ নামক এক প্রকার মদ ছিল। রাসূল (সা.) একজনকে ঘোষণার আদেশ দেন যে, ‘তোমরা সতর্ক হয়ে যাও মদ হারাম করা হয়েছে।’ আনাস বলেন, আবূ ত্বালহা আমাকে বলেন, বেরিয়ে যাও এবং মদ ফেলে দাও, আমি বেরিয়ে গিয়ে তা ফেলে দিয়েছি এর ফলে মদিনার গলি প্রবাহিত হয়ে যায় তাদেরকে নিষেধ করেছেন। এরপর তারা ফুটন্ত হাঁড়ি থেকে তা ফেলে দেন। (সহীহ বুখারী-কিতাবুল মাযালিম, রাস্তায় মদ ঢালা, হা: ১১২/৫,২৪৬৪)।

মদ হারাম ঘোষিত হবার পর প্রকৃত নবীপ্রেকিমদের তাঁর আদেশ পালনার্থে  তা প্রবাহিত করা ব্যতীত আর কিছু করার ছিল না। এ জন্য মদিনার গলিতে মদের স্রোত বয়ে যায়। ইবনু হাজার বলেন, এ বর্ণনা থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, যার কাছে মদ ছিল সে তা ফেলে দেয়, বেশি পরিমাণে মদ ফেলার কারণে মদিনার গলিতে স্রোত বয়ে যায় কোনো বাদ-প্রতিবাদ, দ্বিধা এবং পরামর্শ ছাড়াই মদ ফেলে দেয়ার কাজ সম্পন্ন হয়ে যায়। যেমন- আনাস ইবনু মালিক (রা) কর্তৃক বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি আবূ ত্বালহাকে তার সঙ্গে অমুক অমুককে শারাব পান করাতে রত ছিলাম। ইতোমধ্যে একজন এসে বলে, তোমদের কাছে কি সংবাদ পৌঁছেনি? তারা বলে, কীসের সংবাদ? প্রত্যুত্তরে সে বলে, মদ হারাম করা হয়েছে। তারা বলে, হে আনাস তুমি শরাবের পাত্র গড়িয়ে দাও। আনাস বলেন, তারা সে লোকটির ঘোষণার পরে কাউকে মদ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেননি এবং কারো কাছে যাননি। (সহীহ বুখারী-হা: ৪৬১৭, ৪৩৪১, কিতাবুত তাফসীর পাঠ, হা: ২৭৭)।

আজাবের কথা শুনে নারীর গহনা দিয়ে জাকাত আদায়: পুরুষরাই কেবল রাসূল  (সা.) এর অনুকরণ করেছেন তা নয়, বরং মু‘মিন নারী যারা রাসূলকে (সা.) ভালবেসেছেন তারাও তাঁর আনুগত্য করেছেন। যেমন-‘আব্দুল্লাহ ইবনু‘আমর (রা) কর্তৃক বর্ণিত। তিনি বলেন, এক নারী কন্যাকে সঙ্গে নিয়ে রাসূর (সা.) এর কাছে আসে, তার কন্যার হাতে ছিল দু‘টি সোনার বালা, রাসূল (সা.) বলেন, তুমি কি এর জাকাত আদায় করো? সে বলেন না। রাসূল (সা.) বলেন, সে দু‘টি বালার কারণে কেয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালা তোমাকে জাহান্নামের আগুনের দু‘টি বালা পরালে তুমি কি তাতে সন্তুষ্ট? বর্ণনাকারী বলেন, (এ কথা শুনে) নারীটি তার হাত থেকে সে দু‘টি খুলে রাসূল (সা.) এর কাছে দিয়ে বলেন, এ দু‘টি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা.) এর জন্য। (সহীহ সুনান আবূ দাউদ-হা: ১৫৬৫, ১৫৬৩, কিতাবুয জাকাত পাঠ,‘কানয কি?’ এবং গহনার জাকাত, হা: ২৯১/১৩৮২, শাইখ আলবানী এটিকে উত্তম বলেছেন)।

আল্লাহু আকবার! নবী ভক্তা নারীরাও বালার জাকাত প্রদানের মধ্যে দিয়ে তাঁর (সা.) আনুগত্য সীমাবদ্ধ ছিল না, বরং সে দু‘টি ছেড়ে দেন এবং রাসূল (সা.) এর সামনে সমর্পণ করেন।

গাধার গোশত হারাম ঘোষিত হবার সংবাদ শুনার সঙ্গে সঙ্গে ফুটন্ত পাত্র থেকে তা উলটিয়ে ফেলা: সাহাবাগণের পছন্দনীয় জিনিস নবী (সা.) এর পক্ষ থেকে নিষিদ্ধ ঘোষিত হলে তারা তা অবিলম্বে বর্জন করেছেন। যেমন- আনাস ইবনু মালিক (রা) কর্তৃক বর্ণিত। তিনি বলেন, এক ব্যক্তি রাসূল (সা.) এর কাছে এসে বলে, গৃহপালিত গাধা খেয়ে ফেলা হলো। রাসূল (সা.) নীরব থাকেন, সে দ্বিতীত বার এসে বলে, গৃহপালিত গাধা খেয়ে ফেলা হলো, তিনি চুপ থাকেন, সে তৃতীয় বার এসে বলে, গৃহপালিত গাধা শেষ করে দেয়া হলো। এবার তিনি (সা.) এক ঘোষণাকারীকে  লোকের মাঝে ঘোষণা দেয়ার আদেশ দেন যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল গৃহপালিত গাধার গোশত খেতে তোমাদেরকে নিষেধ করেছেন। এরপর তারা ফুটন্ত হাঁড়ি  থেকে তা ফেলে দেন। (১১৪ সহীহুল বুখারী-হা: ৪১৯৯)।

নিরাপত্তার জন্য আবূ ক্বাতাদার রাত ব্যাপী পদচারণ: নবী প্রেমের এক উজ্জল দৃষ্টান্ত হলো-আবূ ক্বাতাদার! তিনি রাসূল (সা.) এর নিরাপত্তা ও শান্তির ব্যাপারে  এমন গুরত্ব দেন যে, রাসূল (সা.) তন্দ্রার কারণে সাওয়ারীর পিঠ থেকে পড়ে যাবেন এ আশঙ্কায় তাঁর সঙ্গে সারা রাত পদচারণ করেন, যাতে তিনি নিরাপত্তায় থাকেন।

আবূ ক্বাতাদার (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (সা.) আমাদেরকে সম্বোধন করে বলেন, আগামীকাল তোমরা দিনের শেষ ভাগে ও রাতে পথ অতিক্রম করে পানির কাছে পৌঁছে যাবে ইনশা-আল্লাহ। এরপর মানুষ এমনভাবে যেতে থাকে যে, কেউ কারো প্রতি খেয়াল করছে না। আবূ ক্বাতাদার বলেন, আমি রাসূল (সা.) এর পাশে ছিলাম, মধ্য রাতে তাঁর তন্দ্রা আসে যার কারণে তিনি বাহনের পিঠে ঝুঁকে যান। এরপর আমি তাঁর কাছে আসি এবং তাঁকে জাগ্রত না করে সোজা করে দিয়েছি, তিনি সোজা হয়ে যান। এরপর তিনি যেতে থাকেন, যখন রাতের সিংহভাগ সময় কেটে যায় তখন পুনরায় ঝুঁকে যান। আমি তাঁকে না জাগিয়ে স্থির করি, তিনি স্থির হয়ে যান। এরপর যেতে থাকেন যখন রাতের শেষ প্রহর হয়ে আসে তখন তিনি ঝুঁকে যান, আর এটি ছিল প্রথম দুই অবস্থার চেয়ে বেশি বা মারাত্নক, মনে হচ্ছিল তিনি পড়েই যাবেন, আমি তাঁর কাছে আসি এবং স্থির করি। এরপর তিনি মাথা তুলে বলেন এ কোন ব্যক্তি? আমি বললাম, আবূ ক্বাতাদার। তিনি বললেন, কখন থেকে আমার সঙ্গে এভাবে এসেছ? আমি বললাম, প্রথম রাত থেকে। তিনি বলেন, মহান আল্লাহর নবীকে হিফাজতের জন্য আল্লাহ তায়ালা তোমাকে হিফাজত করুন। (সহীহ মুসলিম-হা: ১৫৯৪)।

আবূ দুজানা রাসূল (সা.) এর জন্য ছিলেন ঢালস্বরুপ: ইমাম ইবনু ইসহাক রাসূল (সা.) এর অন্য এক প্রকৃত প্রেমিকের কথা তাঁর ভাষায় এভাবে বর্ণনা করেছেন, আবূ দুজানা রাসূল (সা.) এর জন্য নিজেকে ঢাল বানান। তিনি ঝুঁকে থাকেন এবং তীর তার পিঠে বিঁধতে থাকে, এমন কী তাঁর পিঠে অসংখ্য তীর বিদ্ধ হয়। অন্য বর্ণনায় রয়েছে- এ অবস্থায় তিনি নড়াচড়াও করেননি। আল্লাহু আকবার! কোন বস্তু আবূ দুজনাকে রাসূর (সা.)-এর জন্য ঢাল হওয়া জুঁকা এবং পিঠে তীর বিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও নীরবে ধৈর্যদধারণ করতে উৎসাহিত করেছে? নিশ্চয় সেটি রাসূল (সা.) এর জন্য নির্মল ভালবাসা। (আস সিরাতুন নাব্বীয়াহ,ইবনু হিশাম-৩/৩০,তারিখুল ইসলাম যাহাবী-১৭৪-১৭৫)।

আবূ ত্বালহার বুক রাসূল (সা.) এর বুকের জন্য ঢালস্বরুপ: উহুদের যুদ্ধে রাসূল (সা.) এর প্রকৃত প্রেমিককে দেখা যায়, যিনি নিজ বুককে রাসূল (সা.) এর বুকের সামনে ঢালের ন্যায় রেখেছেন, যাতে শক্র পক্ষের তীর তার শরীরে বিদ্ধ হয় এবং রাসূল (সা.) এর শরীরে যেন কোনো রুপ আঘাত না হানে। ইমাম বুখারী ও মুসলিম বর্ণনা করেন। হাদীসে এসেছে-

আনাস ইবনু (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, উহুদের যুদ্ধে যখন কিছু মানুষ নবীজীকে (সা.) ছেড়ে পেছনে চলে যায় তখন হাতে ঢাল নিয়ে নিজেই তাঁর সামনে ঢালস্বরুপ দাঁড়িয়ে যান। আনাস (রা.) আরো বলেন, আবূ ত্বালহা বিখ্যাত তীরন্দাজ (তীর নিক্ষেপকারী ) ছিলেন। সে দিন তিনি দু‘টি অথবা তিনটি কামান ধ্বংস করেন। আনাস (রা) আরো বলেন, কেউ (রাসূল (সা.) এর সামনে) তীর নিয়ে বেরিয়ে এলে তিনি তাকে বলেছিলেন, তুমি আমার তীর আবূ ত্বালহাকে দিয়ে দাও। তিনি আরো বলেন, যে নবী (সা.) যখন মুশরিকদের দেখার জন্য নিজ মাথা তুলে ছিলেন তখন আবূ ত্বালহা বলেছিলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমার পিতা-মাতা আপনার জন্য কোরবান হোক, আপনি মাথা ওঠাবেন না, এমন না হয় যে মুশরিকদের তীর আপনাকে আঘাত করে। আমার বুক আপনার জন্য ঢালস্বরুপ। (সহীহ বুখারী-হা: ৪০৬৪)।

এগারজন আনসারী ও ত্বালহাহ্ (রা.) এর জান কোরবান: উহুদের যুদ্ধে কোন এক ঘাঁটিতে রাসূল (সা.) এর পক্ষ থেকে পঞ্চাশজন তীর নিক্ষেপে পারদর্শী সাহাবাকে নির্ধারণ করা হয়, তারা সে ঘাঁটি ছেড়ে দিয়ে ভুল করে। যার সুবাদে মক্কার মুশরিকদের কিছু যোদ্ধা খালেদ ইবনু ওয়ালীদের পরিচালনায় পেছন দিক থেকে মুসলিমদের ওপর হামলা চালায়। সে অতর্কিত হামলায় মুসলিমদের এমন দুরাবস্থায় সৃস্টি হয় যে, রাসূল (সা.) এর সংঙ্গে কেবল এক জায়গায় বারজন সাহাবা রয়ে যান এবং মুশরিকরা রাসূর (সা.) এর কাছে পৌঁছে যায়, এমতাবস্থায় প্রকৃত নবীপ্রেমিকজন জীবন কোরবানী সাহাবা কিভাবে প্রতিরোধ করেন তা দেখার বিষয়।

ইমাম নাসায়ী’র জাবির (রা) এর পরম্পরায় বর্ণিত হাদিসে এই প্রশ্নের উত্তর রয়েছে। যাতে তিনি বলেন, উহুদের যুদ্ধে মুসলিমগন যখন বিক্ষিপ্ত হয়ে যান এবং রাসূর (সা.) এর সঙ্গে কেবল ১৬ জন সাহাবা তাদের মধ্যে ত্বালহাহ্ ইবনু উবায়দুল্লাহ ছিলেন তখন মুশরিকরা রাসূল (সা.) এর কাছে এসে যায়। এরপর চোখ উঠিয়ে বলেন, মুশরিকদের মোকাবিলা করবে কে? ত্বালহাহ্ বলেন,আমি। তিনি বলেন, তুমি নিজ স্থানে থাকো। এরপর আনসারদের মধ্য থেকে এক ব্যক্তি বলে, আমি। তিনি বলেন, তুমি (ঠিক আছে মুশরিকদের মোকাবিলা করো) সে ব্যক্তি মুশরিকদের সঙ্গে লড়তে লড়তে শহিদ হয়ে যান। রাসূল (সা.) দেখেন যে, মুশরিকরা নিজেদের স্থানে সুদূঢ় রয়েছে। সে জন্য পুনরায় বলেন, মুশরিকদের সঙ্গে কে মোকাবিলা করবে? ত্বালহাহ্ বলেন, আমি। তিনি বলেন, তুমি নিজ স্থানে থাকো। এরপর আনসারদের এক ব্যক্তি বলেন, আমি। তিনি বলেন, তুমি?(ঠিক আছে মোকাবিলা করো) সে ব্যক্তি লড়তে লড়তে শহিদ হয়ে যান। 

এভাবে রাসূল (সা.) বলতে থাকেন আর আনসারগোষ্ঠীর  মধ্য থেকে এক এক করে আসেন আর মুশরিকদের বিরুদ্ধে লড়েন ও শহিদ হতে থাকেন, শেষ পর্যন্ত রাসূর (সা.) এবং ত্বালহাহ্  অবশিষ্ট থাকেন। রাসূল (সা.) পুনরায় বলেন, মুশরিকদের সঙ্গে কে মোকাবিলা করবে? ত্বালহাহ্ বলেন, আমি। তিনিও এগারোজন আনসারদের  মতো যুদ্ধ করেন। যুদ্ধের সময় তার হাতে আঘাত লাগে ও আঙুল কেটে যায়। তখন তিনি বলেন, (হিস)। রাসূল (সা.) বলেন, তুমি যদি (হিসের পরিবর্তে) বিসমিল্লাহ বলতে তাহলে ফেরেশতাগণ লোকের মাঝখান থেকে তোমাকে উঠিয়ে নেয়ার জন্য প্রস্তুত হতেন। অবশেষে আল্লাহ তায়ালা মুশরিকদের ফিরিয়ে দেন। (সুনান আন্ নাসায়ী-হা: ৩১৪৯)।

আল্লাহু আকবার! রাসূল (সা.) এর প্রকৃত প্রেমে এগারোটি জীবন কোরবান হয়, এরপর বারো নম্বর জীবনও এগিয়ে আসে ও কোরবান হয়ে যায়। এটি সহজ ব্যাপার ছিল না; তার (ত্বালহার) একাকি লড়াই এবং শাহাদাত বরণ, এগারোজন আনসারের সমতুল্য ছিল। তার হাত রাসূল (সা.) এর প্রতিরক্ষার জন্য শক্রর অস্ত্রের আঘাতে শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

ইমাম বুখারী ক্বাইস (রা) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আমি ত্বালহাহ্ (রা) এর সে হাত দেখেছি, যা রাসূল (সা.) এর প্রতিরক্ষার জন্য বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। রাসূল (সা.) এর প্রতিরক্ষার জন্য কেবল তার হাত বিচ্ছিন্ন হয়েছিল তাই নয়; বরং তার সমস্ত শরীর ঝাঁজরা হয়ে গিয়েছিল। তার শরীরে কম-বেশি সত্তর জায়গায় আঘাত লেগে ছিল। ইমাম আবূ দাউদ তায়ালিসী আবূ বকর (রা) এর পরাম্পরায় বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, আমরা তার কাছে গিয়ে দেখি তার লাশটি একটি খালে পড়ে আছে। শরীরে ছিল কম-বেশি তীর-তলোয়ারের সত্তরটি আঘাতের দাগ। (মুসনাদে আবূ দাউদ তায়ালিসী)।

উমর ফারুকের রাসূর (সা.) এর পাশে কবরস্থ হবার আশা:  রাসূল (সা.) এর প্রকৃত প্রেমিক আমীরুল মু‘মিনীন হজরত উমর (রা) এ দুনিয়া ছেড়ে চিরতরে বিদায় নিচ্ছেন, এ সময় তার সবচেয়ে বড় আশা হচ্ছে রাসূর (সা.) এর পাশে কবরস্থ হওয়া। এটি ইমাম বুখারী এভাবে বর্ণনা করেছেন- ‘আমর ইবনু মাইনুন কর্তৃক বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি ‘উমর (রা)-কে বলতে দেখেছি, তিনি আব্দুল্লাহ ইবনু উমর (রা.) বলেন, তুমি মুমিন জননী আয়িশা (রা.) কাছে গিয়ে বলো ‘উমার আপনাকে সালাম দিয়েছেন এবং (আমীরুল মু‘মিনীন বলবে না। কারণ আমি আজ মু‘মিনীনদের আমীর নই) বলো, তিনি নিজ সঙ্গীদ্বয়ের পাশে কবরস্থ হবার জন্য আপনার অনুমতি কামনা করেছেন। ‘আব্দুল্লাহ ইবনু ‘উমার তার ওপর সালাম দিয়ে অনুমতি চেয়ে ‘আয়িশাহ‘র কাছে যান, (তখন তিনি বসে বসে কান্না করছিলেন। তিনি তাকে বলেন,‘উমার ইবনু খাত্তাব (রা) আপনাকে সালাম দিয়েছেন এবং তার সঙ্গীদ্বয়ের  নিকট দাফন হবার জন্য অনুমতি চাচ্ছেন) প্রত্যুত্তরে তিনি বলেন, এ স্থানটি আমি নিজের জন্য রেখেছিলাম, কিন্তু আজ আমি তাকে নিজের ওপর অগ্রাধিকার দিচ্ছি। তিনি যখন ফিরে আসেন তখন বলা হয়, এতো ‘আব্দুল্লাহ ইবনু ‘উমার ফিরে এসেছেন। এরপর তিনি বলেন,(আমাকে ওঠাও এক ব্যক্তি তাকে নিজের ওপর হেলান দিয়ে বসান। এরপর বলেন,) তোমার কাছে কী (সংবাদ) আছে? তিনি বলেন, তিনি (আয়িশাহ) আপনার জন্য অনুমতি দিয়েছেন।(‘উমার আল-হামদুলিল্লাহ বলার পর বলেন) সে স্থানটির চেয়ে আমার কাছে আর কিছু গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। আমি যখন মৃত্যু বরণ করব তখন আমাকে তার (আয়িশাহ্‘র) কাছে নিয়ে যাবে এবং অনুমতি চাইবে যদি অনুমতি দেন তাহলে আমাকে সেখানে দাফন করবে অথবা মুসলিমগণের কবরস্থানে দাফন করবে। (সহীহ বুখারী-হা:-১৩৯২)।

জান্নাতে রাসূল (সা.) এর সঙ্গী হওয়ার জন্য আবেদন: আরো একজন প্রকৃত নবীপ্রেমিক রাবী‘আহ্ ইবনু ক্বা‘ব আল-আসলামীকে আবেদন করার সুযোগ দেয়া হলো তার আবেদন কী ছিল? ইমাম মুসলিম তার আবেদনের কথা তার ভাষায় এভাবে বর্ণনা করেছেন- রাবী‘আহ্ ইবনু ক্বা‘ব (রা.) হতে বর্ণিত, আমি রাসূল (সা.) এর কাছে রাত কাটাতাম। (একদিন) তাঁর কাছে ওজুর পানি এবং প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে উপস্থিত হলাম। এরপর তিনি আমাকে বলেন, তুমি কিছু চাও। আমি বললাম, জান্নাতে আপনার সঙ্গী হতে চাই। তিনি বললেন, এছাড়া আর কিছু? আমি বললাম, এটাই। তিনি বললেন, (এ আশা পূরণের জন্য) বেশি বেশি সাজদাহ করে আমাকে সহযোগিতা করো। ( সহীহ মুসলিম- হা:-১১২২)।

নিউজওয়ান২৪.কম/আরাফ