জিলহজ মাসের তাৎপর্য, ফজিলত ও করণীয়
ধর্ম ডেস্ক
ফাইল ফটো
যুদ্ধ-বিগ্রহ, অনাচার, অবিচার মোটকথা সব ধরনের জুলুম নিষেধ করা হয়েছে সম্মানিত জিলহজ মাসে। সম্মানিত মাস চারটি। জিলকদ, জিলহজ, মহররম ও রজব।
পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘আকাশ মণ্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টির দিন থেকেই মহান আল্লাহর কাছে ও মহান আল্লাহর বিধানে মাসের সংখ্যা বারটি এর মধ্যে চারটি মাসে যুদ্ধ নিষিদ্ধ। এটাই সুপ্রতিষ্ঠিত বিধান। সুতরাং এই মাসগুলোতে তোমরা যুদ্ধ করে নিজেদের প্রতি জুলুম করো না। আর তোমরা মুশরিকদের সঙ্গে সর্বাত্মকভাবে যুদ্ধ করবে যেমন তারা তোমাদের সঙ্গে সর্বাত্মকভাবে যুদ্ধ করে থাকে এবং জেনে রাখো আল্লাহ মুত্তাকীদের সঙ্গে আছেন।’ (সূরা: তওবা, আয়াত: ৩৬)।
পবিত্র কোরআনে অন্যত্র ইরশাদ হয়েছে ‘সম্মানিত মাস সম্পর্কে আপনার কাছে জিজ্ঞেস করে যে, তাতে যুদ্ধ করা কেমন? বলে দাও এতে যুদ্ধ করা ভীষণ বড় পাপ। আর আল্লাহর পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা এবং কুফুরি করা, মসজিদে-হারামের পথে বাঁধা দেয়া এবং সেখানকার অধিবাসীদেরকে বহিস্কার করা, আল্লাহর নিকট তার চেয়েও বড় পাপ। আর ধর্মের ব্যাপারে ফেতনা সৃষ্টি করা নরহত্যা অপেক্ষাও মহা পাপ। বস্তুতঃ তারা তো সর্বদাই তোমাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে থাকবে, যাতে করে তোমাদেরকে দ্বীন থেকে ফিরিয়ে দিতে পারে যদি সম্ভব হয়। তোমাদের মধ্যে যারা নিজের দ্বীন থেকে ফিরে দাঁড়াবে এবং কাফের অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে, দুনিয়া ও আখেরাতে তাদের যাবতীয় আমল বিনষ্ট হয়ে যাবে। আর তারাই হলো দোজখবাসী। তাতে তারা চিরকাল বাস করবে।’ (সূরা: বাকারা, আয়াত আয়াত: ২১৭)।
মহান আল্লাহর বিধানানুসারে যে চারটি মাস পবিত্র ও সম্মানিত, তার একটি হলো জিলহজ মাস। এ মাসের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ সময় হলো জিলহজ মাসের প্রথম দশক। পবিত্র কোরআন ও হাদিসে এই দশকের বিশেষ ফজিলত, গুরুত্ব ও তাৎপর্যের কথা বর্ণিত হয়েছে। স্বয়ং মহান আল্লাহ এই দশকের সম্মান ও পবিত্রতা প্রকাশ করে এই দশকের রাতগুলোর নামে শপথ করেছেন। ইরশাদ হয়েছে। ‘শপথ ভোরবেলার, শপথ দশ রাত্রির।’ (সূরা: আল ফজর, আয়াত: ১-২)।
হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আববাস রা. ও মুজাহিদ রহ. সহ অধিকাংশ সাহাবী, তাবেয়ী ও মুফাস্সিরগণের মতে এখানে দশ রাতের দ্বারা জিলহজ মাসের প্রথম দশ রাতকেই বুঝানো হয়েছে। হাফেজ ইবনে কাসির রহ. বলেন, এটিই বিশুদ্ধ মত। (তাফসিরে ইবনে কাসির ৪/৫৩৫-৫৩৬)
হাদিস শরিফে এই দশককে দুনিয়ার সবচেয়ে উত্তম ও মর্যাদাবান দশক হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। হজরত জাবির (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন ‘দুনিয়ার সর্বোত্তম দিনগুলো হলো জিলহজের দশ দিন। জিজ্ঞেসা করা হলো, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও কী তার সমতুল্য নয়? তিনি বললেন, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও তার সমতুল্য নয়, তবে ওই ব্যক্তি, যার চেহারা ধূলিযুক্ত হয়েছে, অর্থাৎ শাহদাতের মর্যাদা লাভ করেছে।’ (মুসনাদে বাযযার, হাদিস : ১১২৮; মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদিস : ২০১০)।
অন্য বর্ণনায় হজরত জাবির (রা.) হতে বর্ণিত হয়েছে, ‘জিলহজের দশ দিনের চেয়ে কোনো দিনই আল্লাহর নিকট উত্তম নয়।’ (সহিহ ইবনে হিববান, হাদিস : ২৮৪২)।
জিলহজ মাসের অনন্য ফজিলত:
হজরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মতের জন্য বিশেষ বিশেষ দিন ও রাতের ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। পূর্ববর্তী নবীদের উম্মতগণ দীর্ঘ হায়াত পেতেন। আর এ উম্মত পূর্ববর্তী উম্মতের ন্যায় দীর্ঘ হায়াত পান না অথচ এ উম্মত পূর্ববর্তী সকল উম্মতের চেয়ে উত্তম। তাই এ উম্মতের জন্য বিশেষ বিশেষ দিন ও রাতের ফজিলত বর্ণিত হয়েছে। ফজিলতপূর্ণ এ দিনের মাঝে অন্যতম জিলহজের প্রথম দশক। কোরআন-হাদিসে বর্ণিত জিলহজের প্রথম দশকের ফজিলত নিচে তুলে ধরা হলো।
জিলহজের প্রথম দশকে আল্লাহর জিকির সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে মহান আল্লাহ বলেন, ‘নির্দিষ্ট দিনসমূহে তারা যেন আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে সেই সকল পশুর ওপর, যা তিনি তাদের দিয়েছেন।’ (সূরা হজ আয়াত ২৮)। ইমাম বুখারী (রহ.) বলেন, হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন, ‘সুনির্দিষ্ট দিনসমূহ’ দ্বারা জিলহজের দশ দিনই উদ্দেশ্য। অনুরূপভাবে হজরত ইবনে ওমর (রা.), হাসান বসরী (রহ.), আতা (রহ.), মুজাহিদ (রহ.), ইকরামা (রহ.), কাতাদাহ (রহ.), ইমাম নাখায়ী (রহ.), ইমাম আবু হানিফা (রহ.), ইমাম শাফেয়ী (রহ.), ইমাম আহমদ (রহ.)-সহ অধিকাংশ উলামায়ে কেরামের অভিমত সুনির্দিষ্ট দিনসমূহ দ্বারা জিলহজের দশ দিনই বোঝানো হয়েছে। (তাফসিরে ইবনে কাসির ৩/২৮৯)।
মহান আল্লাহর কাছে জিলহজ মাসের প্রথম দশকের নেক আমলের চেয়ে অধিক প্রিয় অন্য কোনো আমল নেই। হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে, হজরত ইবনে আববাস (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘মহান আল্লাহর নিকট জিলহজের দশ দিনের নেক আমলের চেয়ে অধিক প্রিয় অন্য কোনো দিনের আমল নেই। সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও (এর চেয়ে উত্তম) নয়? তিনি (সা.) বললেন, না, আল্লাহর রাস্তায় জিহাদও নয়। তবে হ্যাঁ, সেই ব্যক্তির জিহাদ এর চেয়ে উত্তম, যে নিজের জানমাল নিয়ে আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের জন্য বের হয়েছে, তারপর কোনো কিছুই নিয়ে ফিরে আসেনি। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৯৬৯; সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৭৫৭)।
হজরত জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘মহান আল্লাহর কাছে জিলহজের প্রথম দশক থেকে উত্তম আর কোনো দিনই নেই।’ (ইবনে হিব্বান হাদিস নং-২৮৪২)।
অপর এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘দুনিয়ার দিনসমূহের মধ্যে সর্বোত্তম হচ্ছে জিলহজের প্রথম দশক।’ (মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদিস: ২০১০)। অন্যত্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘এমন কোনো দিন নেই যে দিনসমূহের নেক আমল মহান আল্লাহর কাছে জিলহজের প্রথম দশকের নেক আমল থেকে অধিক প্রিয়।’ (সহিহ বুখারি (১/১৩২)।
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, জিলহজের দশ দিনের ইবাদত আল্লাহর নিকট অন্য দিনের ইবাদত তুলনায় বেশি প্রিয়, প্রত্যেক দিনের রোজা এক বছরের রোজার ন্যায় আর প্রত্যেক রাতের ইবাদত লাইলাতুল কদরের ইবাদতের ন্যায়। (তিরমিজি শরীফ, হাদিস: ৭৫৮)।
জিলহজ মাসের প্রথম দশকের ফজিলত ও তাৎপর্য বর্ণনা করতে গিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘মহান আল্লাহর কাছে এই দশ দিনের ইবাদত অন্যান্য দিনের ইবাদতের চেয়ে বেশি প্রিয় যদিও সেই ইবাদত নফল নামাজ, জিকির, তাসবিহ কিংবা সদকা হয়।’ (সহিহ বুখারি : ৯৬৯)।
জিলহজের প্রথম দশকে তাসবিহ, তাহলিল, তাহমিদ ও তাকবির পাঠ করার কথা হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘মহান আল্লাহর কাছে জিলহজের দশকের আমলের চেয়ে অধিক মহৎ এবং অধিক প্রিয় অন্য কোনো দিনের আমল নেই। সুতরাং তোমরা সেই দিনগুলোতে অধিক পরিমাণে তাসবিহ (সুবহানাল্লাহ) তাহমিদ (আলহামদুলিল্লাহ) তাহলিল (লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ) ও তাকবির (আল্লাহু আকবার) পাঠ কর। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ৫৪৪৬; মাজমাউয যাওয়াইদ, হাদিস : ৫৯৩২)।
জিলহজ মাসের প্রথম দশকের প্রত্যেক রাত ইবাদতে কাটানো সারা বছর হজ ও ওমরাহ করে কাটানোর ন্যায়। হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি জিলহজ মাসের প্রথম দশকের প্রত্যেক রাত ইবাদতে কাটালো সে যেন সারা বছর হজ ও ওমরাহ করে কাটালো এবং যে ব্যক্তি এ দশকে ঈদের দিন পর্যন্ত রোজা রাখলো সে যেন সারা বছরই রোজা রাখলো। (মুকাশিফাতুল কুলুব)।
অন্য হাদিসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘এই দিনগুলোর একেকটি রোজা এক বছরের রোজার সমতুল্য। এই দশ রাতের প্রতিটি রাতের ইবাদত শবে কদরের ইবাদতের সমতুল্য।’ (সুনানে তিরমিজি : ৭৬৩)।
৯ই জিলহজ আরাফার দিনের রোজার স্বতন্ত্র ফজিলত হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আরাফার দিনের রোজা সম্পর্কে আমি মহান আল্লাহর কাছে আশা করি যে, তিনি এর দ্বারা পূর্ববর্তী এক বছর এবং পরবর্তী এক বছরের গোনাহ ক্ষমা করে দেবেন। (সুনানে তিরমিজি ১ : ১৫৭)।
হজরত হাফসা (রা.) বর্ণনা করেন, চারটি আমল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কখনো ছাড়তেন না। আশুরার রোজা, জিলহজের প্রথম দশকের রোজা, প্রত্যেক মাসের তিন দিনের রোজা, ফজরের আগে দুই রাকাত সুন্নত নামাজ। (সুনানে নাসায়ী, হাদিস : ২৪১৫)।
অধিকাংশ ফকিহগণ এই নয় দিনে রোজা রাখা উত্তম বলেছেন। ৯ই জিলহজ রোজা রাখা মুস্তাহাব। সুতরাং আমাদের দেশের চাঁদের হিসেবে যেদিন ৯ তারিখ হয় সে দিনই ইয়াওমে আরাফা হিসেবে রোজা রাখা মুস্তাহাব হবে। সৌদির হিসেবে আরাফার দিন অনুযায়ী নয়। মহান আল্লাহ আমাদেরকে জিলহজ মাসের আমলগুললো যথাযথভাবে পালন করার তাওফিক দান করুন। আল্লাহুম্মা আমিন।
লেখক: মাওলানা ওমর ফারুক
নিউজওয়ান২৪.কম/আহনাফ
- যে দোয়ায় গলার কাঁটা নেমে যাবে ইনশাল্লাহ!
- ফরজ নামাজের পর প্রয়োজনীয় কিছু আমল
- দরুদে ইব্রাহিম
- মা-বাবার জন্য দোয়া
- তাহিয়্যাতুল-মাসজিদ
মসজিদে ঢুকেই দু’রাকাত নামাজ... - পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সময়সূচি...
- দরুদে ইব্রাহিম
- কোরআন হাদিসের আলোকে জুমা’র দিনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
- ঋণ মুক্তির সর্বোত্তম আমল
- ফজিলতপূর্ণ কিছু দোয়া ও আমলসমূহ
- পবিত্র কোরআনের তথ্যকণিকা
- জুমার দিনের ৩ আমল
- হযরত আদম আ. এর বিয়ের মহর কত ছিল!
- ফেরেশতা পরিচিতি...
- ‘নিশ্চয় নামাজ অশ্লীল ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখে’