ঢাকা, ২৮ এপ্রিল, ২০২৫
সর্বশেষ:

ক্ষমা প্রার্থনার চেয়ে বড় পলিটিক্স আর নেই!

ধ্রুব নীল

প্রকাশিত: ১৫:৩৪, ১৮ জানুয়ারি ২০১৬   আপডেট: ১৪:৩৭, ২০ মে ২০১৬

মানুষ যে একটা সভ্য প্রাণী সেটা প্রমাণ করতে এখন ক্রিকেট খেলতে হয়। বেচারা গেইল। একটা প্রেমের প্রস্তাবই তো দিয়েছেন, তাতেই যেভাবে গোটা দুনিয়া পেছনে লাগলো, তাতে ক্যারিয়ারটা যেন আচমকা পিকেটার আর দাঙ্গা পুলিশের মাঝে পড়ে গেছে। সমালোচনাগুলোকে বাউন্ডারির বাইরে পাঠাতে পারছেন না। দেখে শুনে চুপ থাকতে হচ্ছে। এই বুঝি বাদ পড়লেন।

বলা হয় ক্রিকেট ভদ্রলোকদের খেলা। এখানে প্রেমের প্রস্তাব দেওয়া মানা। বাকিসব খেলা সম্ভবত অভদ্রদের। এই যেমন রাজনীতি। যা মুখে আসে বলে দাও। যাকে খুশি দলে ভেড়াও। যাকে খুশি পাত্তা দাও, আবার দল ছেড়ে কেউ চলে গেলেও যেন খেতে হচ্ছে হোঁচট। সত্য মিথ্যা আকথা কুকথা; স্লেজিংও চলে চূড়ান্ত। তবে এই খেলার সবচেয়ে বড় সুবিধা এখানে রেফারি নেই। ফাউল করো ইচ্ছামতো। কেউ দুই পয়সা জরিমানা করবে না। বড়জোর একটা মামলা করা যায়। আর তাতেই বা কী। একের পর এক হাজিরার তারিখ পড়বে, আর অজুহাতও গজাবে একশ দুটা। পরোয়ানা হবে, কিন্তু সেটা পৌঁছাবে না থানায়। মাঝে বিরতিহীন রাজনৈতিক অভব্যতা চলবেই।

শুধু যে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে উল্টোপাল্টা কথা তা নয়, স্বেচ্ছাচারী আচরণের অভিযোগ আছে বিএনপির দল চালানোর ক্ষেত্রেও। যার সাম্প্রতিক ফল হিসেবে বিশ দলীয় জোটে ভাঙনের সুর। ধরা যাক সরকারের প্রভাবও আছে এক চামচ। রাজনীতির খাতিরে প্রতিপক্ষকে দুর্বল করে টিকিয়ে রাখতে চেয়েছিল সরকার। অনেকটা পোলিওর ভ্যাকসিনের মতো। সবল থাকতে চাইলে নিজের ভেতর দুর্বল ভাইরাস ঢুকিয়ে রাখো। যেন বাইরে থেকে মনে হয়, বিরোধী দল একটা জীবিত আছে। এ বেলা নতুন করে দল বেঁধে আর লাভ নেই। কিন্তু যে জোট চাইলেই ক্ষমতাসীনরা ভেঙে দিতে পারে, সে জোট আবার কেমন জোট! জোটের গ্লু তথা আঠাটা তাহলে কোথায়? জোট ভাঙার জন্য আওয়ামী লীগকে দোষ দিয়ে মির্জা ফখরুল সাহেব তো আখেরে নিজেদের আরও দুর্বল প্রমাণ করলেন।

গণতন্ত্র মানে তো এই নয় যে বিরোধীদের দুধ-কলা খাইয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে রাখবে সরকার। উনাদের সমাবেশ করতে দিতে হবে, জোট ঠিক রাখতে দিতে হবে, গ্রেফতার করা যাবে না, নির্বাচন করার জন্য দেশের দায়ভার শিকেয় তুলে রাখতে হবে ইত্যাদি ইত্যাদি। এত কিছু চাইতে গেলে রাজনীতি না করে বরং ক্রিকেট খেলুন। শুধু সেখানেই নির্দলীয় নিরপেক্ষ থার্ড আম্পায়ার পাওয়া সম্ভব।

এখন প্রশ্ন হলো বিএনপি কী করবে? জোটের আঠা শুকাবে নাকি ভেতরের কলকব্জায় নজর দেবে? আঠা শুকানোর জন্য কিছু সময় চেপে ধরে রাখতে হয়। এমনি এমনি বসে থাকলে বন্ধন মজবুত না হওয়ারই কথা। খবরে জানা গেল ইসলামী ঐক্যজোটের নেতাকর্মীদের বিশেষ একটা পাত্তা দিতো না বিএনপির হাইকমান্ড। তাদের ধারণা ছিল ছাতার তলে আছে, এই তো অনেক! কোলে এনে বসাতে হবে নাকি। এমন ধারণার কারণে নাকি সময়ে সময়ে সভা সমাবেশেও ন্যূনতম মেহমানদারীটা পেতেন না অপেক্ষাকৃত ছোট দলটির নেতারা। হতে পারে এ কারণেই আচমকা তারা নিজেদের ‘বড় কিছু’ প্রমাণের জন্য পক্ষত্যাগের পথ বেছে নিলেন। ঘোষণা দিলেন নতুন জোট গড়ার। টনকও নড়লেও বিএনপির কোষ্ঠকাঠিন্য দশা- জোটত্যাগীদের কিছু বলতেও পারছে না, সইতেও পারছে না। ঢোক গিলে বার বার সরকারকেই দোষ দিয়ে এ যাত্রা রেহাই পেতে হচ্ছে।

কিন্তু সরকার কি বিরোধী দলের অভিভাবক? নাকি বিরোধীদের অধিকার পকেটে নিয়ে ঘোরে? যে, মন চাইল একটু অধিকার বের করে দিলাম, মন চাইল ধমক দিয়ে ঠাণ্ডা করে দিলাম, কার সঙ্গে মিশবে, কার সঙ্গে মিশবে না সেটাও ঠিক করে দিলাম। ক্ষমতাসীনরা যা যা করে, সেটা দেখতে পাওয়ার প্লের মতো মনে হলেও আদতে তা রাজনীতিই। খেলাটা এমনই। সাপ মরবে, লাঠি টেরও পাবে না। কানকথায় শোনা যায়, স্থাপনা সংক্রান্ত কিছু ইস্যু ইসলামী ঐক্যজোটের ওপর প্রভাব খাটানোর সুযোগ এনে দিয়েছে সরকারকে। সেইসঙ্গে যোগ হয়েছে বিএনপির সাংগঠনিক অসাড়তা। জোট ভাঙার আভাস পাওয়ার মুহূর্তেই যদি বিএনপি নেতারা যাদের অপেক্ষাকৃত দুর্বল নগণ্য ভেবে এসেছেন, তাদেরকে চটজলদি গুরুত্ব দিয়ে মিটিং বৈঠক করে আপসরফায় আসতেন তবে সেটা হতে পারতো কৌশলী ট্যাকলিং।

মোটকথা, দেশের রাজনীতির জন্য এখন একটা জমাটি পরিবেশ দরকার। দীর্ঘ সময় সরকারে থেকে আওয়ামী লীগের ভেতরেও এক ধরনের টাইপড ভাব চলে এসেছে। সব কিছুতে দাঁড়িয়ে গেছে বিশেষ মেকানিজম। আর কোনও কাজ না পেয়ে খই ভাজতে ভাজতে বিএনপিতেও মরচে পড়েছে। রাজনীতির মাঠে খেলাটাও ঠিক জমছে না। আমরা বিনীতভাবেই চাই নেতারা নেতাগিরি ফলাক, ক্ষমতা দেখিয়ে ভালো কিছু করুক। দুর্নীতি দেখা মাত্র একে ওকে ধরে সাসপেন্ড করুক, কলার ধরে দুর্নীতিবাজকে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার মতো কিছু স্টান্টবাজি দেখাক। এই খেলা না জমলে নেতারাও তাদের নেতাগিরি ছেড়ে হয়ে যাবেন আগাগোড়া ব্যবসায়ী আর টেন্ডারের পাহারাদার।

সরকারও সমালোচনার বাউন্সারে মনোযোগ দিন, কিছু সমালোচনাকে মাথা নিচু করে সমীহ করতে হবে, আর কিছু সমালোচনাকে উড়িয়ে দিতে হবে বাউন্ডারির ওইপারে। মানে দলের বা প্রশাসনের কারও বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ আসা মাত্র অ্যাকশন নিতে হবে দ্রুত। এ ধরনের প্রতিটি অ্যাকশন মানে ভোটব্যাংকে আরও কিছু ডেপোজিট জমা হওয়া।

বিএনপি এখন ব্যাট করছে না। তারা আছে মাঠে। তাদের বেছে নিতে হবে ফিল্ডিংয়ের নতুন কৌশল। গয়েশ্বরের মতো দুয়েকজনকে দ্বাদশ প্লেয়ার বানালে দলের কিছু হবে না, তবে ভয়ানকভাবে নাড়া খাওয়া ইমেজের দণ্ডটা কিছুটা হলেও হালে পানি পাবে। পৌর নির্বাচনে ভোটের হার দেখে বোঝা যায় বিএনপি এ পর্যন্ত যতই ভুল সিদ্ধান্ত আর ভুল কথা বলুক না কেন, এর ব্র্যান্ড ভ্যালু এখনও একেবারে ধুলোয় মেটেনি। কিছু মানুষের মনে এখনও পুরনো ধানের শীষ দোলা দেয় বটে। কিন্তু হালজামানার পাকিস্তানি ঘরানার না-পাক কথাগুলো চরম বিএনপি সমর্থকের কানেও ভীষণ আপত্তিকর শোনায়। এ গন্ধ দূর করার কোনও টোটকা আপাতত জানা নেই।

তবে পলিটিক্সে অসম্ভব বলেও কিছু নেই। এখন বিএনপি যদি আদৌ নতুন কোনও ক্যাপ্টেনের অধীনে ব্র্যান্ড ভ্যালুকে পুঁজি করে মাঠে বুদ্ধিদীপ্ত কোনও ফরমেশনে আসতে চায়, তো সেটাকে সাধুবাদ জানাতেও দোষ কোথায়। এক্ষেত্রে বিএনপির কানে কানে সবিনয়ে একটা ক্রিকেটীয় টিপস দিতে চাই। সেটা হলো- বিনয় আর ক্ষমা প্রার্থনার চেয়ে বড় পলিটিক্স আর নেই!

dhrubonil@yahoo.com 

লেখক: শিশু সাহিত্যিক, সাংবাদিক

নিউজওয়ান২৪.কম/এসএল

 

ইত্যাদি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত