ঢাকা, ২২ নভেম্বর, ২০২৪
সর্বশেষ:

কেমন আছেন মিয়ানমারের অন্য মুসলমানরা, শুনলে আতঁকে উঠেবেন

নিউজ ওয়ান ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৭:১৩, ২৭ অক্টোবর ২০১৭  

তুন চি`র কাছে মিয়ানমারই তার বাড়ি, তার ঠিকানা, তার মাতৃভূমি। কারণ, এই দেশে তিনি জন্মেছেন, বড় হয়েছেন। অন্য হাজারো বার্মিজদের মতো মিলিটারি জান্তার বিরুদ্ধে তিনিও রাস্তায় আন্দোলন করেছেন গণতন্ত্রের দাবিতে। দশ বছর তিনি কারাগারেও কাটিয়েছেন।

আজ তিনি মিয়ানমারের সাবেক রাজবন্দী পরিষদে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন। তিনি ওইসব মুসলমানদের একজন, যারা আশা করেন যে ২০১০ সালে সেনা-শাসনের অবসানের পর মুসলমানরা সমাজে তাদের যথাযথ অবস্থান ফিরে পাবে।

তিনি বিবিসির সংবাদদাতা আনবারাসান এথিরাজনকে বলেন, "২০১২ সালে রাখাইনে সহিংসতার পরই পরিস্থিতি পাল্টে যায়। কেবল রোহিঙ্গা মুসলিমরাই উল্টো স্রোতের মুখোমুখি হয়েছেন এমন নয়, পুরো মুসলমান সম্প্রদায়ই আসলে এই সমস্যার মধ্যে পড়ে গেছেন।"

মি. চি`র পূর্বপুরুষরা এক সময় ভারত থেকে বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমারে এসেছিলেন। এসেছিলেন অনেক পুরুষ আগে, তখন দেশটি বার্মা নামে পরিচিত ছিল।

২০১২ সালে পশ্চিমাঞ্চলীয় রাখাইন প্রদেশে বৌদ্ধ আর রোহিঙ্গা মুসলমানদের মধ্যে সংঘর্ষের পর এক লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হয়েছিলেন। বেশিরভাগ বাস্তুচ্যুত, বিশেষ করে রোহিঙ্গা মুসলমানরা শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে আশ্রয় নেন।

বিবিসির সাংবাদিক আনবারাসান এথিরাজন বলেন, আমাকে ইয়াঙ্গুনের একটি মসজিদে এক শুক্রবার আমন্ত্রণ জানানো হলো। আমি দেখলাম শতশত পুরুষ মসজিদে ঢুকছে। অনেকের মাথায় টুপি, তাঁরা নামাজের জন্য তৈরি হচ্ছেন। প্রার্থনার জন্য আসা অনেকের সঙ্গে আলাপে এটা পরিষ্কার বুঝতে পারলাম রাখাইনে যা ঘটছে তা নিয়ে এই সম্প্রদায়ের মানুষ কতটা অস্বস্তিতে আছে।

রোহিঙ্গা মুসলিম জঙ্গি গোষ্ঠী আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা আরসা ২৫শে অগাস্টে রাখাইন অঞ্চলে মিয়ানমারের নিরাপত্তা চৌকিতে একযোগে হামলা করার পর সেখানে সহিংসতা শুরু হয়। জবাবে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী পাল্টা ব্যবস্থা নেয়, যাকে তারা বলছে সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান।

এরপর পাঁচ লাখেও বেশি রোহিঙ্গা মুসলিম সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচে। উঠে আসে ধর্ষণ আর বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সব খবরাখবর।

রোহিঙ্গাদের এই পালিয়ে বাঁচাকে জাতিসংঘের সিনিয়র কর্মকর্তা এবং মানবাধিকার কর্মীরা বর্ণনা করেছেন "জাতিগত নিধন" হিসেবে - তবে মিয়ানমারের সরকার এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

"রাখাইন রাজ্যের সমস্যা খুবই ভয়ঙ্কর," নামাজ পড়তে আসা মুহাম্মদ ইউনুস আমাকে ফিসফিস করে বললেন। "এমন উদ্বেগও আছে যে সহিংসতা ইয়াঙ্গুন এবং অন্যান্য এলাকাতেও ছড়াতে পারে।"

তিনি বিবিসিকে বলেন, যে দেশের অন্য এলাকার মুসলমানরা কী বলছেন কিংবা প্রতিদিন কী ধরণের কাজ করছেন - এসব নিয়ে খুব সাবধানী হয়েছেন।

রাখাইনে জন্ম নিয়েছেন এবং বড় হয়েছেন এমন অনেক মানুষ এখন ইয়াঙ্গুনে বসবাস করছেন। এমনই একজন ইউনুস।

তিনি বিবিসিকে জানান, তাঁরা তাদের পরিবারের সদস্য আর আত্মীয়দের নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে রয়েছেন।

ধারণা করা হয় যে মিয়ানমারের পাঁচ কোটি ৩০ লাখ বাসিন্দার মধ্যে ৪.৫ শতাংশ মুসলমান। রোহিঙ্গাদের ধরেই এই হিসাব। তবে মুসলিম নেতারা এমন যুক্তি দেন যে তাদের আসল সংখ্যা সরকারি হিসাবের দ্বিগুণের মতো হতে পারে।

অনেক রিপোর্টে বলা হয় যে মুসলমানরা মিয়ানমারে শতশত বছর ধরে বাস করছেন। ব্রিটিশ শাসনের সময় তাদের সংখ্যা বাড়ে, কারণ সে সময় অনেকে দেশটিতে অভিবাসী হয় কিংবা তাদেরকে ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে নিয়ে আসা হয়।

রোহিঙ্গা মুসলমানদের ভাষা দক্ষিণ এবং কেন্দ্রীয় মিয়ানমারে বাস করা মুসলমানদের থেকে আলাদা। আর রোহিঙ্গাদের বেশিরভাগেরই বসবাস রাখাইন রাজ্যে।

মুসলমান নেতারা বলছেন, তাদের জনগোষ্ঠীর সংখ্যা বেশ বড় হলেও পার্লামেন্টে মুসলিম কোনো সদস্য নেই, আর এই কারণে তারা হতাশ।

২০১৫ সালের নির্বাচনের পর অং সান সু চি`র দল ন্যাশনাল লীগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) ক্ষমতায় আসে। কিন্তু এই দলও নির্বাচনে কোনো মুসলিম প্রার্থী দেয়নি।

ইসলামিক সেন্টার অব মিয়ানমারের মুখ্য আহবায়ক, আলহাজ্ব উ আয়ে লিউইন বিবিসিকে বলেন, "আমরা অনুভব করি সব রকমভাবেই আমরা বৈষম্যে শিকার হচ্ছি।"

তিনি বলেন, ১৯৬২ সালে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করার পর থেকেই এই অবস্থা চলছে এবং তখন থেকেই গুরুত্বপূর্ণ সরকারি পদ হতে মুসলমানদের সরিয়ে দেয়া শুরু হয়।

"আপনি এখন পুলিশ বাহিনীতে এমনকি একজন জুনিয়র (মুসলিম) কর্মকর্তা খুঁজে পাবেন না - সেনাবাহিনী তো অনেক দূরের কথা," জানালেন মি. লিউইন। তিনি যুক্তি দেন যে সরকার থেকেই বৈষম্যের ঘটনা বেশি হচ্ছে এবং একেবারে নিচু পর্যায়ে এটা এতো বিস্তৃত নয়।

সাবেক জাতিসংঘ মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে যে স্বাধীন উপদেষ্টা কমিশন গঠন করা হয়েছিল, তার একজন সদস্য হলেন মি. লিউইন। রাখাইন রাজ্যে বিরোধের সমাধান খুঁজে বের করতে এই কমিশন গঠন করা হয়েছিল।

অং সান সু চি ২০১৬ সালে এই কমিশন গঠন করেন। সর্বশেষ দফার সহিংসতা শুরুর একদিন আগে, অর্থাৎ ২৪শে আগস্ট কমিশন তাদের সুপারিশ পেশ করে।

মি. লিউইন বলেন, মিজ সু চি হয়তো নিখুঁত নন, কিন্তু "তিনিই আমাদের একমাত্র আশা"।

এই মুসলিম নেতা বলেন, ‘‘রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে তাঁর পক্ষে যতটুকু করা সম্ভব, মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সিলর ততটুকু করেছেন। তিনি যদি খোলামেলাভাবে মুসলমানদের পক্ষে কথা বলা শুরু করেন, তবে তা হবে তাঁর জন্য রাজনৈতিকভাবে আত্মহত্যা করার শামিল। আমরা চাইনা যে সেটা ঘটুক।"

তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, ‘‘পশ্চিমা বিশ্বের এটা বুঝতে হবে তাকে নিন্দিত করে ক্ষমতা থেকে সরালে মিয়ানমার আবারও কর্তৃত্ববাদী শাসনে ফিরে যেতে পারে। তখন কেবলমাত্র একনায়কেরাই ফিরে আসবে।"

ডেইলি বাংলাদেশ/আরএ

অর্থ-কড়ি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত