ঢাকা, ০৫ ডিসেম্বর, ২০২৪
সর্বশেষ:

ঋতুস্রাবে স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করছেন তো?

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৩:৪৩, ১৭ নভেম্বর ২০১৮  

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি


পিরিয়ডের সময়ে আজকাল প্রায় নারীই নানা ব্র্যান্ডের পছন্দ ও সুবিধামতো স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করেন। যা স্বাস্থ্যঝুঁকি অনেকটা কমিয়ে দেয়। কিন্তু অনেকে আবার উচ্চমূল্যের কারণে তা ব্যবহারে করছেনা। যা বয়ে আনতে পারে মারাত্মক সব রোগ। চুলকানি, র‍্যাশ, ত্বকের নানান রকম অসুখ থেকে শুরু করে হতে পারে ক্যান্সার পর্যন্ত।

এ বিষয়ে সামাজিক লজ্জা না ভাঙলে সচেতনতা আসবে না৷ তাই মেয়েরাও ঋতুস্রাব নিয়ে সচেতন হবে না৷ তাদের মতে দেশের অধিকাংশ নারী ঋতুস্রাবের সময় নিরাপদ পদ্ধতি ব্যবহার করে না৷ সচেতনতা ছাড়াও এর পেছনে স্যানিটারি ন্যাপকিনের দামও বড় ভূমিকা পালন করে৷

বাংলাদেশের দরিদ্র নারী জনগোষ্ঠী দাম বেশি বলে স্যানিটারি ন্যাপকিনের বদলে পুরোনো কাপড়, টিস্যু ব্যবহার করে যা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ৷ নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় স্যানিটারি ন্যাপকিন সুলভমূল্যে সব স্তরের নারীর হাতে না পৌঁছানোকে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগের অভাব বলে মনে করেন নারী চিকিৎসক ও নারী নেত্রীরা।

রাজধানীর মহাখালীর একটি তৈরি পোশাক প্রতিষ্ঠানে সহকারী অপারেটর হিসেবে কাজ করেন শিল্পী আক্তার। ঋতুকালীন সময়ে তিনি স্যানিটারি ন্যাপকিন বা প্যাড ব্যবহার করেন না।

বিষয়টি অস্বস্তিকর হলেও শুধু উচ্চমূল্যের কারণে প্রতিমাসে এ কষ্ট সহ্য করেন তিনি। একই বক্তব্য তেজাগাঁওয়ের গৃহপরিচারিকা ফুলবানুর। তারা জানান, দাম বেশি হওয়ার কারণেই তারা প্রয়োজনীয় এই পণ্য ব্যবহারের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

দরিদ্র ও আয়ের নারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি প্যাকেট স্যানিটারি ন্যাপকিনের দাম ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। মাসিক আয়ের ১০০ টাকা এ খাতে ব্যয় করলে অন্য গুরুত্বপূর্ণ খাতের হিসাব মেলানো দায় হয়ে পড়ে। তাই ইচ্ছা থাকলেও তারা এটা ব্যবহার করতে পারছেন না। ২০১৪ সালের বাংলাদেশ ন্যাশনাল হাইজিন বেসলাইন সার্ভে থেকে জানা যায়, এ কারণেই এখনও মাত্র দশ শতাংশ নারী স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করেন। আর ৮৬ শতাংশ নারীকে ঋতুকালীন সময়ে ব্যবহার করতে হয় পুরাতন কাপড় বা তুলা।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরিতে ব্যবহৃত কাঁচামালের ওপর বিভিন্ন স্তরে কর দিতে হয়। ফলে বাজারজাতকরণের পর এর যে মূল্য দাঁড়ায়, তা বেশির ভাগ নারীর ক্রয়ক্ষমতার বাইরে থাকে। এটি শুধু যে দরিদ্র জনসাধারণের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য তা নয়; এর ফলে মধ্যবিত্ত পরিবারের নারীরাও আর্থিক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন।

বাজার ঘুরে দেখা গেছে, দেশের প্রথম স্যানিটারি ন্যাপকিন ‘সেনোরা’। বর্তমানে এটি ছাড়াও বাজারে রয়েছে মোনালিসা, ফ্রিডম, জয়া, স্যাভেলন এবং ইভানাসহ নানা ব্র্যান্ডের প্যাড। প্রতিটি কোম্পানির স্যানিটারি ন্যাপকিনের মূল্যই দরিদ্র শ্রেণীর নারীদের সামর্থ্যরে বাইরে। স্কয়ারের ১৫ পিসের এক প্যাকেট সেনোরার দাম ১২০ টাকা, সেনোরা কনফিডেন্স ১৬ পিস ১৫০ টাকা, সেনোরা কনফিডেন্স আল্ট্রা ৮ পিস ১১০ টাকা, সেনোরা কনফিডেন্স সুপার ১০ পিস ১১০ টাকা, সেনোরা স্যানিটারি রেগুলার ১০ পিস ৯০ টাকা, সেনোরা কনফিডেন্স রেগুলার ১০ পিস ১১৫ টাকা এবং পাঁচ পিসের দাম ৬০ টাকা। এসিআই লিমিটেডের স্যাভলোন ফ্রিডম কম্বোপ্যাক ১০ পিস ১১০ টাকা, আট পিস হ্যাভি ১১০ টাকা, ১৬ পিস হ্যাভি ২০০ টাকা, ফ্রিডম রেগুলার ১০ পিস ১১০ টাকা, ২০ পিস ২০০ টাকা, এসএমসির জয়া আট পিস ১০০ টাকা। এ ছাড়া সানিডে আট পিস ১৩০ টাকা, হুইসপার ১৩৩ টাকা, সোফি ৭৬ টাকা, স্টেসেফ ১০০ টাকা এবং মোলপেড ২৩৫ টাকা।

জানা গেছে, আন্তর্জাতিক মানের স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরিতে ব্যবহৃত কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। এ ক্ষেত্রে টোটাল ট্যাক্স ইনসিডেন্ট (টিটিআই) ১২৭ দশমিক ৮৪ শতাংশ। যেখানে ২৫ শতাংশ দিতে হয় কাস্টমস ডিউটি, ৪৫ শতাংশ সাপ্লিমেন্টারি ডিউটি, ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ৫ শতাংশ অগ্রিম আয় কর (এআইটি), ৩ শতাংশ রেগুলেটরি ডিউটি এবং ৪ শতাংশ এটিভি। এছাড়া বড় দোকান থেকে কিনতে গেলে আরও ৫ শতাংশ অতিরিক্ত কর দিতে হয় ক্রেতাকে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মহিলা ফোরামের সহসভাপতি অ্যাডভোকেট সুলতানা আক্তার রুবী বলেন, এ বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আমরা নারীদের সম্মিলিত সমস্যা নিয়ে কথা বললেও এ বিষয়টি পৃথকভাবে আলোচনায় নিয়ে আসিনি। অথচ এটি নারীর জন্য অত্যাবশ্যকীয় অধিকার। তিনি বলেন, স্যানিটারি ন্যাপকিন বা প্যাড কোনো বিলাসী পণ্য নয় যে এটার ওপর করের বোঝা চাপাতে হবে। সুস্থ জাতির জন্য নারীদের সুস্থ থাকা জরুরি। তাই নারীদের প্রয়োজনীয় এ দ্রব্যের দাম কমাতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

২০১৪ সালের বাংলাদেশ ন্যাশনাল হাইজিন বেসলাইন সার্ভে থেকে জানা যায়, দেশের ৪০ শতাংশ মেয়ে মাসিক ঋতুচক্রের সময় তিন দিন স্কুলে যায় না। এই ৪০ শতাংশের তিন ভাগের এক ভাগ মেয়ে জানিয়েছে, স্কুল কামাই দেয়ার কারণে তাদের লেখাপড়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অপর দিকে, ৬ শতাংশ মেয়ে ঋতুকালীন সমস্যা ও এর প্রতিকার সম্পর্কে স্কুলে জানতে পারে।

স্কুলে টয়লেটগুলোতে কাপড় পরিবর্তন করার সুযোগ ও ব্যবহৃত ন্যাপকিন ফেলার ব্যবস্থা না থাকা, মেয়েদের জন্য পৃথক কমনরুম না থাকা, মাসিকের রক্ত লেগে যাওয়ার ভয়, সহপাঠীরা টিজ করবে সেই লজ্জায় মাসিকের দিনগুলোতে স্কুলে যেতে এমনকি ঘর থেকে বের হতেও অস্বস্তিবোধ করেন অনেক মেয়ে।

অথচ স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞদের মতে, এ সময় প্রতি ছয় ঘণ্টা অন্তর ন্যাপকিন পাল্টানো প্রয়োজন। অন্যথায় ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের ঝুঁকি থাকে এবং নানা রোগ দেখা দিতে পারে। ঋতুকালীন স্বাস্থ্যবিধি পালন না করা ও স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার না করায় নারীরা বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্মুখীন হন। 

এ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত কনসালটেন্ট (গাইনী ও প্রসূতি) ডা. আরিফা শারমিন বলেন, মাসিকের সময় পুরাতন কাপড় বা তুলা ব্যবহারের ফলে লোকাল ইনফেকশন হতে পারে।

যৌনাঙ্গে ফাঙ্গাস বা ছত্রাকের আক্রমণ হতে পারে। যা ক্রনিক আকার ধারণ করলে তলপেটে ব্যথা, বমি হওয়া বা ভ্যাজাইনোটিস হতে পারে। তিনি বলেন, মাসিককালীন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় এ ক্ষেত্রে স্যানিটারি ন্যাপকিন বা প্যাড ব্যবহার হতে পারে নিরাপদ পদ্ধতি। তবে মূল্য সাশ্রয়ী না হওয়ায় অনেক দরিদ্র কিশোরী-নারীরা ন্যাপকিন বা প্যাড ব্যবহার করতে পারেন না। তাই দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সুস্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে এগুলোর দাম কমানোর উদ্যোগ গ্রহণ করা উচিত বলে মনে করেন তিনি।

নিউজওয়ান২৪/এমএম

লাইফস্টাইল বিভাগের সর্বাধিক পঠিত