ঢাকা, ২০ এপ্রিল, ২০২৫
সর্বশেষ:

ইয়াতিমের হক

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৪:৫৩, ১ নভেম্বর ২০১৮  

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

ইসলামের বিধান সকল মানুষের সঙ্গে সদাচরণের শিক্ষা দেয়।বিশেষ করে সমাজের ঐ শ্রেণীর মানুষ যারা অবহেলিত, দুঃস্থ, অসহায়, ইয়াতিম এবং মজলুম এসকল মানুষের প্রতি বিত্তবানদের রয়েছে অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য।

সকল অসহায় মানুষকে সাহায্য, দান ও সহযোগিতার প্রতি ইসলাম অধিক গুরুত্বারোপ করেছে।

মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনুল কারিমের অনেক জায়গায় সমাজের সব অসহায়, দুঃস্থ, ইয়াতিম ও মজুলম মানুষের প্রতি সদয় হওয়ার জন্য যথাযথ দায়িত্ব কর্তব্য পালনের জন্য নির্দেশ প্রদান করেছেন। পবিত্র কোরআন মাজীদে মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ পাক বলেছেন যে,

لَّيْسَ الْبِرَّ أَن تُوَلُّواْ وُجُوهَكُمْ قِبَلَ الْمَشْرِقِ وَالْمَغْرِبِ وَلَـكِنَّ الْبِرَّ مَنْ آمَنَ بِاللّهِ وَالْيَوْمِ الآخِرِ وَالْمَلآئِكَةِ وَالْكِتَابِ وَالنَّبِيِّينَ وَآتَى الْمَالَ عَلَى حُبِّهِ ذَوِي الْقُرْبَىوَالْيَتَامَى وَالْمَسَاكِينَ وَابْنَ السَّبِيلِ وَالسَّآئِلِينَ وَفِي الرِّقَابِ وَأَقَامَ الصَّلاةَ وَآتَى الزَّكَاةَ وَالْمُوفُونَ بِعَهْدِهِمْ إِذَا عَاهَدُواْ وَالصَّابِرِينَ فِي الْبَأْسَاء والضَّرَّاء وَحِينَ الْبَأْسِ أُولَـئِكَ الَّذِينَ صَدَقُوا وَأُولَـئِكَ هُمُ الْمُتَّقُونَ

‘সৎকর্ম শুধু এই নয় যে, পূর্ব কিংবা পশ্চিমদিকে মুখ করবে, বরং বড় সৎকাজ হলো এই যে, ঈমান আনবে আল্লাহর ওপর কিয়ামত দিবসের ওপর, ফেরেশতাদের ওপর এবং সমস্ত নবী-রাসূলগণের ওপর, আর সম্পদ ব্যয় করবে তারই মহব্বতে আত্নীয়-স্বজন, ইয়াতিম-মিসকীন, মুসাফির-ভিক্ষুক ও মুক্তিকামী ক্রীতদাসদের জন্যে। আর যারা নামায প্রতিষ্ঠা করে, যাকাত দান করে এবং যারা কৃত প্রতিজ্ঞা সম্পাদনকারী এবং অভাবে, রোগে-শোকে ও যুদ্ধের সময় ধৈর্য্য ধারণকারী তারাই হলো সত্যাশ্রয়ী, আর তারাই পরহেজগার।’ (সূরা: বাকারা, আয়াত: ১৭৭) আজকের আলোচনার বিষয়বস্তু হচ্ছে ইসলামে ইয়াতিমের হক। পবিত্র কোরআনের ১২টি সূরার ২২টি আয়াতে ইয়াতিমের কথা বলা আছে। ইয়াতিমের হক, ইয়াতিমের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য, ইয়াতিমের হক ভক্ষণের শাস্তি ইত্যাদি বিষয়ে পবিত্র কোরআনে বিশদভাবে উল্লেখ রয়েছে।

অসহায় পিতৃহীন বা অভিভাবকহীন শিশুরাই মূলত অনাথ বা ইয়াতিম শিশু। যেসব শিশু জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত হওয়ার পূর্বেই পিতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত হয়েছে তারা সবার স্নেহ-ভালোবাসা পাবার হকদার। অনাথদের দায়িত্ব নেওয়া এবং তাদের প্রতি উদারতা দেখানো শুধু মানবিক কাজই নয়; বরং এটি ইবাদতও বটে।

অনাথদের রক্ষার ব্যাপারে মহান আল্লাহ পাক সূরা নিসায় ইরশাদ করেছেন যে,

‘আর তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, তার সঙ্গে কাউকে শরিক করোনা। পিতা-মাতার সঙ্গে সৎ ও সদয় ব্যবহার কর এবং নিকট আত্মীয়, ইয়াতিম, নিঃস্ব, প্রতিবেশী, অসহায় পথিক এবং দাস-দাসীদের প্রতিও।’ (সূরা: আন-নিসা, আয়াত: ৩৬)

মহান আল্লাহ পাক অসহায় ইয়াতিমদের হক আদায় না করা এবং মিসকিনদের খাবার না দেয়া লোকদেরকে সম্পর্কে সূরা মাউনে বলেছেন,

‘তুমি কি এমন লোককে দেখেছ, যে দ্বীনকে অস্বীকার করে ? সে তো ওই ব্যক্তি যে ইয়াতিমের প্রতি রুঢ় আচরণ করে তাড়িয়ে দেয় আর মিসকিনদের খাবার প্রদানে মানুষকে নিরুৎসাহিত করে।’ (সূরা: মাউন, আয়াত: ১-৩) অসহায় ইয়াতিমদের প্রতি যথার্থ সম্মান, স্নেহ, ভালোবাসা প্রদর্শন না করার অর্থ হলো তাদের প্রাপ্য হক আদায় না করা এবং তাদের প্রয়োজনীয় ব্যয়ভার বহন না করা এবং তাদের দুঃখে-কষ্টে সহযোগিতা না করা। এ কারণে আল্লাহ তায়ালা ইয়াতিম, মিসকিন, দুঃস্থ, অসহায় ও মজলুমদের প্রতি সম্মান ও সহযোগিতার প্রতি উদ্বুদ্ধ করতে পবিত্র কোরআনের আয়াত নাজিল করে বলেন,

‘কখনো যেন এরুপ না হয় যে, তোমরা ইয়াতিমদের সম্মান করো না; আর মিসকিনদের খাদ্যদানে (অন্যকে) উৎসাহিত করো না।’ (সূরা: ফাজর, আয়াত: ১৭-১৮)

ইয়াতিমদের সম্পর্কে অনেক হাদিসসমূহ এসেছে-

নবী করীম (সা.) ইরশাদ ফরমান যে, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে ইয়াতিম অনাথদের মাথায় স্নেহের হাত বোলাবে, ইয়াতিমের স্পর্শিত প্রত্যেকটি চুলের বিনিময়ে আল্লাহ ঐ স্নেহকারীকে অসংখ্য নেকী দান করবেন।’ (তিরমিযী)

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, নবী করীম (সা.) বলেন, ‘মুসলমানদের সর্বাপেক্ষা উত্তম গৃহ হলো সে গৃহ, যে গৃহে কোনো ইয়াতিম বসবাস করে আর সে গৃহবাসীরা তার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করে; এবং সবচেয়ে মন্দ গৃহ সে গৃহ, যে গৃহে কোনো ইয়াতিম থাকে অথচ সে গৃহবাসীরা তার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করে না।’ (ইবনে মাজাহ)

যারা দুনিয়ার জীবনে ইয়াতিম, মিসকিন, দুঃস্থ, অসহায় ও বন্দিদের ওপর ইহসান করে, আল্লাহ তায়ালা তাদেরকে পরকালে জান্নাত ও জান্নাতের বহু নিয়ামত প্রদানের ঘোষণা দিয়েছেন। বিশেষ করে ইয়াতিম ও মিসকিনদের সহায়তা দান জান্নাতি মানুষের স্বভাব।

মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআন মাজীদে বলেন,

‘তারা দুনিয়ার জীবনে খাদ্যদ্রব্যের প্রতি নিজেদের প্রয়োজন আসক্তি থাকা সত্ত্বেও আল্লাহর প্রেমে মিসকিন, ইয়াতিম ও বন্দিদের আহার প্রদান করে।’ (সূরা: দাহর, আয়াত: ৮)

এবং এ সম্পর্কে বুখারী শরীফের এক বর্ণনায় এসেছে যে, নবী করীম (সা.) বলেন, ‘আমি এবং অনাথের দায়িত্বগ্রহণকারী জান্নাতে এই দুই আঙ্গুলির মত কাছাকাছি থাকব। এ কথা বলে তিনি তর্জনী এবং মধ্যমা অঙ্গুলির মাঝে একটু ফাঁক করলেন।’ এর দ্বারা বুঝা যায় ইয়াতিমের লালনপালনকারী জান্নাতে নবীজীর খুব কাছাকাছি থাকবেন। (সহীহ বুখারী) ইসলামে ইয়াতিমের হক ভক্ষণকারীদের জন্য রয়েছে ভয়ংকর দুঃসংবাদ ও শাস্তি । এ সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআন মাজীদে বলেছেন যে,

‘ইয়াতীমদেরকে তাদের সম্পদ বুঝিয়ে দাও। খারাপ মালামালের সঙ্গে ভালো মালামালের অদল-বদল করো না। আর তাদের ধন-সম্পদ নিজেদের ধন-সম্পদের সঙ্গে সংমিশ্রিত করে তা গ্রাস করো না। নিশ্চয় এটা বড়ই মন্দ কাজ।’ (সূরা: আন- নিসা, আয়াত: ২) এরপর মহান রাব্বুল আলামীন আল্লাহ তায়ালা কঠোর ভাষায় বলেন, ‘যারা ইয়াতিমদের অর্থ-সম্পদ অন্যায়ভাবে খায়, তারা নিজেদের পেটে আগুনই ভর্তি করেছে এবং সত্ত্বরই তারা অগ্নিতে প্রবেশ করবে।’ (সূরা: আন-নিসা, আয়াত: ১০)

এ সম্পর্কে নবী করীম (সা.) বলেছেন, ‘বৃহদাকারের ৭টি মারাত্মক গুনাহের একটি হলো, ইয়াতিমের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করা।’ (সহীহ বুখারী: ১/৩৮৮, হাদীস: ২৭৬৬, সহীহ মুসলিম: ১/৬৪, হাদীস: ৮৯) কিন্তু বর্তমান যুগের মানুষের চিত্র হলো, তারা শরীয়তের এই কঠোর নির্দেশনাগুলোকে একদিকে ফেলে রেখেছে। সম্পত্তি বণ্টনের ক্ষেত্রে একে অন্যকে বঞ্চিত করার প্রতিযোগিতায় মেতে থাকে। মনে রাখতে হবে, যেদিন এই মুকাদ্দমাগুলো সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারক মহান রাব্বুল আলামীন আল্লাহ তায়ালার আদালতে উত্থিত হবে সেদিন ওই অধিকার গ্রাসকারীদেরকে ধিক্কারজনক পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে।

তারা কি জানে না যে, ভাই-বোনের অধিকার গ্রাস করা শুধু সম্পদ গ্রাস-ই নয়; এর মাধ্যমে আত্মীয়তার সম্পর্ক নষ্ট করার মতো নিকৃষ্ট গুনাহ-ও হয়ে থাকে। যে ব্যক্তি অন্য ভাই-বোনের অধিকার গ্রাস করে সে দুনিয়া ও আখেরাতের কোথাও শান্তি পাবে না।

তাই আমাদের সকলের উচিত ইয়াতিমদের হক আদায় করা যেনো তারাও সমাজে অন্যান্য মানুষের ন্যায় সুন্দরভাবে জীবনযাপন করতে পারে।

নিউজওয়ান২৪/জেডএস