ঢাকা, ২১ এপ্রিল, ২০২৫
সর্বশেষ:

আমাদের পাগলীটা গতকাল ভোরে পরপারে চলে গেছে...

সাইফুদ্দিন আহমেদ নান্নু

প্রকাশিত: ১৭:৩০, ১২ নভেম্বর ২০১৬   আপডেট: ১৪:৫০, ১৪ নভেম্বর ২০১৬

এক পাগলী, দুই পুলিশ ও মা-ছেলের গল্প...

আজ থেকে ৩২ কিংবা ৩৩ বছর আগে এই মানুষটি আমাদের বাড়ির পাশের এই শহীদ মিনারে বসেছিল, শরীর জুড়ে ময়লার মোটা আস্তরণ। মাথায় ছিলো মস্ত জটা। সে জটা থেকে উকুন ঝরতো টুপটাপ বৃষ্টির মতো।

সে সময়ের অসীম কৌতুহলী তরুন ডিবি কনস্টেবল মেজাফ্ফর হোসেন তার সাথে কথা বললেন, কিন্তু ভাষা এমনই জড়ানো এবং দুর্বোধ্য ছিলো যে তার কোন কথার অর্থই বোঝা যায়নি। তাতে কী, সকালে-দুপুরে দোকান থেকে রুটি কিনে খাওয়ান । এরপর থেকে দুজনের মাঝে সখ্য। এমনি করে চললো দিন তিনেক।

মাছের পোকা ছিলেন মোজাফ্ফর ভাই । ফাঁক পেলেই ঝাঁকি জাল দিয়ে মাছ ধরতেন। একদিন মাঝ ধরে জাল শুকাতে দেয়া শেষ করে হুট করেই পাগলীর হাত-পা বেঁধে ফেললেন । পাগলীর দুর্বোধ্য চেঁচামেচি-চিৎকারের মধ্যেই কাঁচি দিয়ে ঘ্যাঁচ ঘ্যাঁচ করে মাখার জটাকে ভূপতিত করলেন।

পাগলীর মাথা তখন কৃষ্ণকদমের মত। এখানেই শেষ নয়,বাঁধন খুলে একরকম পাঁজকোলা করেই নিয়ে গেলেন পাশের পুকুরে। সাবান দিয়ে গোসল করিয়ে নতুন কাপড় পড়িয়ে তারপর ছাড়লেন। এরপর দুজনের মধ্যে মা-ছেলের মত স্বর্গীয় সম্পর্ক। খাওয়া পড়া একসাথে। ‘জটাপাগলী’র রাত কাটতো পুলিশ ক্লাবের বারান্দার লোহার খাটিয়ায়। দিন গড়ানোর সাথে ভাষাও স্পষ্ট হয় তার। আমাদের পাড়ার সবার সাথে তার মিষ্টিভাব। অপূর্ব সুন্দর করে হাসতো দেখা হলেই, আজও হাসে। বছর দুয়েক পর মোজাফ্ফর সাহেবেরে বদলি। মানিকগঞ্জ থেকে ময়মনসিংহ। বিদায় বেলায় দুজনের হৃদয়ভাঙা কান্নায় পুরো পাড়া স্তব্ধ।

সদর থানার ওসি তখন আব্দুল হাই। অভিজাত পরিবারের শিক্ষিত সন্তান,অসম্ভব ভাল মানুষ ছিলেন। সবাই বলতো “এই মানুষটা কেন যে দারোগাগিরি করতে এসেছে !” সেই হাই সাহেব মোজাফ্ফর কনস্টেবলের পিঠে হাত রেখে বললেন ,“ চিন্তা করো না,যাও আমি আছি,পাগলিকে আমি দেখবো।”

হাই সাহেব যতদিন ছিলেন এই মানুষটি তার বাসাতেই থাকতেন খেতেন। এরপর বেশ ক বছর একাধিকবার পাগলী মাকে দেখে গেছেন মোজাফ্ফর হোসেন। হটাৎ করে আর আসেন নি তিনি।

হাই সাহেবও একদিন চলে গেলেন, কবে তাকে রেখে গেলেন পাড়ার দোকানদার শাজাহান ভাইর কাছে। সেই থেকে প্রায় দুই যুগ শাজাহান ভাইয়ের বাড়িতেই তার জীবন। ৩০/৩২ বছর আগে মানুষটি দেখতে যেমনটি ছিলো আজও অনেকটা তেমনই আছে,সেই হাসিমুখ আজও অমলিন ।

বহুবছর কেটে গেলেও সেই পুলিশ ক্লাব,সেই শহীদ মিনারকে ভুলে যায়নি সে,দিনে অন্তত: একবার শহীদ মিনারের বেদীতে চুপচাপ বসে থাকেন আর নিষ্পলক তাকিয়ে থাকেন পুলিশ ক্লাবের দিকে। হয়তো তার মাতৃহৃদয় খুঁজে ফিরে মোজাফ্ফর কনস্টেবলকে,যে তাকে মায়ের মত ভালবাসতেন।

পাগলীটা তার বাড়ির ঠিকানা বলতে বলে বরিশালের উজিরপুর । আর কিচ্ছু জানে না কিংবা বলে না,হয়তো কোন অভিমান তাকে তাড়িয়ে ফিরে।

[২০১৫ সালের ১৭ অক্টোবর তাঁকে নিয়ে এই লেখাটি ফেসবুকে লিখেছিলাম। শিরোনাম ছিল,“একজন মোজাফ্ফর কনস্টেবল”। গতকাল (শুক্রবার) ভোরে সেই পাগলী, ডিবি `কনস্টেবল মোজাফফরের মা`, এতদিনে এলাকার অচ্ছেদ্য অঙ্গে পরিণত হওয়া সুফিয়া (সম্ভবত, আসল নাম নিশ্চিত নই) পাগলী শেষনিঃস্বাস ত্যাগ করেছেন]

হে পরম করুণাময়, তুমি তাঁকে পারলৌকিক শান্তি দিও!

লেখক: মানিকগঞ্জ নিবাসী বিশিষ্ট সাংবাদিক

নিউজওয়ান২৪.কম/একে

ইত্যাদি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত