‘মোঘল- ইংরেজদের আতংকের নগরী ছিল- ঢাকা’
এইচ এম বাবু
নিউজওয়ান২৪
প্রকাশিত : ১০:৩৭ এএম, ৩১ জুলাই ২০১৯ বুধবার
ছবি: সংগৃহীত
১৬১০ সাল। মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর ঢাকার নতুন নামকরণ ও রাজধানী ঘোষণার পর ঘুরতে আসতে চেয়েছিলেন এই নগরীতে। কিন্তু মশার উপদ্রপের কথা শুনে পর পর ২ বার তার যাত্রা বাতিল করেন।
ঐতিহাসিকভাবেই ঢাকা মশার জন্য কুখ্যাত ছিল। মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে মুঘলরা বাংলার রাজধানী বর্ষায় ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদ সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিল। এরপর ১ আগস্ট ১৮৬৪ সালে ঢাকা পৌর সভার মর্যাদা লাভ করে কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
১৯০১ সালের গোড়ার দিককার কথা। ঢাকায় বিদ্যুৎ চালু হয় ডিসেম্বরে। ইংরেজ শাসনামলে ঢাকায় তাদের যে ক্যান্টনমেন্টে ছিল (পুরানা পল্টন এলাকায়; পল্টন মানে ‘সেন’ ইউনিট) সেটি মূলত ব্যবহৃত হতো বেয়ারা সৈনিকদের টাইট দেয়ার জন্য পানিশমেন্ট পোস্টিং হিসেবে। সমগ্র ভারতবর্ষে যত বেয়ারা সৈনিক, তাদেরকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেয়া হতো, মশার কামড় ম্যালেরিয়া বাঁধিয়ে তারা সোজা হয়ে যেত।
১৯৪৭ সাল। কালক্রমে ব্রিটিশরা চলে গেল, পাকিস্তান তৈরি হলো। ঢাকা হলো পূর্ব বাংলার রাজধানী। নতুন দেশের নতুন রাজধানীতে লোকজন বসতবাড়ি করতে শুরু করল। ভারত, পাকিস্তান থেকে লাখ লাখ মুসলমান এসে ঢাকাতেই উঠলো। আজিমপুর, কাটাবন, নব্য ধানমন্ডি, মতিঝিল, মোহম্মদপুর, গুলশানের বিশাল বিশাল জংগল কেটে বাস করতে থাকলো মানুষ।
জঙ্গলে নতুন রক্তে মশার বংশ বৃদ্ধি আরো দ্বিগুণ হলো। সন্ধ্যার দিকে তাঁতী বাজার, লক্ষীবাজার, শাখারী বাজারের বউ-ঝি’রা যখন পুজোর জন্য ধুপকাঠি জ্বালাতো তখন নাকি নতুন এলাকাগুলোতে ঝাকে ঝাকে মশারা চলে আসতো। মশার অত্যাচার এতোই বেশি ছিল যে, কোট-কাচারিতে বা সচিবালয়ে বড় বাবুরা কাজ করতে পারতেন না দিনের বেলায়। ১৯৫৫/৫৬ দিকে রাতে পুলিশের টহল বন্ধ করতে বাধ্য হয় প্রশাসন।
সেই সময় পূর্ব পাকিস্তানের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পেলেন ফেনীর সন্তান হাবিবুল্লাহ বাহার চৌধুরী। কলকাতা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সাবেক অধিনায়ক। এই মানুষটি কথা কম বলতেন, কাজ বেশি করতেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে ২০ হাজার মশার ওষুধ ছিটানোর মেশিন আনালেন (ব্রাশের তৈরি এই মশার ওষুধ ছেটানোর লম্বা টিউব আকৃতির যন্ত্রগুলো ১৯৮৫/ ৯০ সাল পর্যন্ত ঢাকা শহরে দেখা গেছে)।
তিনি সাত দিন ধরে কোনো বিশ্রাম না নিয়ে রোড ম্যাপ তৈরি করলেন। কেন, কী জন্য মশার ভয়ে অচল এই নগরী? তাই রাস্তার পাশে গভীর ড্রেন খনন করালেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আধুনিক করলেন, শহরের সবগুলো পুকুর খাল ডোবা পরিষ্কার করালেন। বুড়িগঙ্গার সঙ্গে নগরের লিঙ্কেজ তৈরি করলেন। বনেদি ইস্পাহানীর সহায়তায় মশার ওষুধ ছিটানোর উপযোগী দুটো বিমান পর্যন্ত ক্রয় করালেন।
পঞ্চাশ দশকে মাত্র দুই বছরের মধ্যে উনি ঢাকার মশাকে এমন শায়েস্তা করলেন যে, উনার মৃত্যুর আরো ২৫ বছর পর অর্থাৎ ১৯৭৮/ ৮০ সালেও ঢাকা শহরের মানুষ মশারি না টানিয়ে ঘুমাতে পারতো। দরিদ্র বা বস্তিবাসীর মুখে মুখে তার সুনাম ছিল।
১৯৮৫ সালের পর আবার সেই পুরোনো রুপ ফিরে পায় ঢাকা। মশা নিয়ন্ত্রণে ৩০ বছর নতুন কোনো কাজ হয়নি বলে এই সময়টির মাঝে মশাদের বংশ বৃদ্ধি পায় কয়েক গুণ। ১৯৮৮ সালের বন্যার পর থেকে আজ অবধি হাবিবুল্লাহ্ সাহেবের মতো কেউ আধুনিক চিন্তা বা নগরবাসীর কথা ভাবতে পারেনি। আফসোস, একজন রুপকার বা মডেল হিসেবে এ মানুষটির নাম মশক নিধন অধিদফতরে সংরক্ষিত থাকা উচিত ছিল, কিন্তু কেউ তা করেনি।
গত ৩ যুগে পিতা হিসেবে এ শহরের সন্তানরা পেয়েছে ১০% কিংবা ২০ পার্সেন্ট খোর অসৎ, অযোগ্য, পল্টিবাজ, সংস্কারপন্থী মানুষদের (মেয়র হানিফ ব্যাতীত)। আজকে ডেঙ্গু মহামারি, এই সব অসৎ পিতার অবৈধ কাজের ফসল। আজ নগরবাসীর সমস্ত ক্ষোভ, ঘৃণা বর্তমান অথর্ব, অবাল মেয়রদের দিকে। হাসপাতালের বেডে শুয়ে একটি শিশু- যতবার পেট উগলে বমি করছে, সব গিয়ে পড়ছে এই কথিত পিতার মুখে।
(নিচের ছবিটি দৈনিক সংবাদের লুৎফর রহমান বেনুর ১৯৮৫ সালে তোলা। রাজধানীর আরামবাগের পীর জঙ্গী মাজার রোডের ছবি। বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সেন্ট্রাল কমান্ডের চেয়ারম্যান মেসবাহউদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে মিছিলটি শাপলা চত্ত্বর, দৈনিক বাংলা, জিরো পয়েন্ট, গুলিস্তান হয়ে বঙ্গভবনের সামনে অবস্থান নেয় মিছিলটি)।
বি: দ্র: এ লেখার মতামত সম্পূর্ণ লেখকের। এর জন্য সম্পাদকের দায়বদ্ধতা নেই।
নিউজওয়ান২৪.কম/আ.রাফি