ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামের প্রতিবেদন: এক রোল মডেল বাংলাদেশ
নিউজ ডেস্ক
নিউজওয়ান২৪
প্রকাশিত : ০৯:১২ পিএম, ২১ জুন ২০১৯ শুক্রবার

ছবি: সংগৃহীত
ডিজিটাল অর্থনীতিতে উন্নত বিশ্বে যেভাবে এক রোল মডেল বাংলাদেশ।
বিশ্ব দরবারে ক্রমবর্ধমান উন্নয়নের এক নাম বাংলাদেশ। ডিজিটালাইজেশনের দ্রুত আবির্ভাবের সঙ্গে অনেক উন্নয়নশীল দেশই এখন ডিজিটাল অর্থনীতিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করছে। বিশ্বে ডিজিটাল আউটসোর্সিংয়ের জন্য এক জনপ্রিয় নামে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে 'ডিজিটাল অর্থনীতি' কীভাবে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে রুপান্তরিত করছে তা তুলে ধরেছে।
একটি দেশের অর্থনীতির ডিজিটালাইজেশান কেবল তার পরিষেবা শিল্পে উদ্ভাবনকেই পরিচালনা করে না বরং এটি দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটিয়ে স্থানীয় পর্যায়ের অনেক কাজের সুযোগও বৃদ্ধি করে। আর, এ ক্ষেত্রে বিশ্বের অনেক উন্নত দেশও বাংলাদেশকে রোল মডেল হিসেবে অনুস্মরণ করার পরিকল্পনা করছে। ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে কাজ করায় খরচ এবং ঝুঁকি কমিয়ে আনা সম্ভব, তাই যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়ার মতো উন্নত দেশের বৃহদাকার কর্পোরেশনগুলোও বাংলাদেশের মতো আইটি আউটসোর্সিংয়ের দিকে ঝুঁকছে।
ফ্রিল্যান্সিংয়ের মধ্যে কম্পিউটার প্রোগ্রামিং থেকে শুরু করে ওয়েব ডিজাইন, ট্যাক্স প্রস্তুতি এবং সার্চ ইঞ্জিন অপ্টিমাইজেশানের মতো প্রায় সব কাজই অন্তর্ভুক্ত। উদীয়মান বাজারগুলো মানুষের জন্য কাজের নতুন নতুন সুযোগ বিস্তৃত করেছে যা এর আগে বিদ্যমান ছিল না। আউটসোর্সিং সেবা প্রদানের জন্য বিশ্বে এশিয়া এক নম্বর অঞ্চল হিসেবে গড়ে উঠেছে।
ছবি : ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম
বাংলাদেশ সেনা আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রভাষক এজাজ জামানের লেখা নিবন্ধটি বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম প্রতিবেদন আকারে প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ফ্রিল্যান্সিং অনেক সুবিধাই প্রদান করে যার মধ্যে রয়েছে ক্লায়েন্ট এবং প্রকল্প বাছাই, কাজ করার স্থান বা কর্মক্ষেত্রের শিথিলতা এবং কাজের স্বাধীনতাসহ বিশ্ব বাজারে প্রবেশের সুযোগ।
একজন বাংলাদেশির কাছে ফ্রিল্যান্সিংয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপকারিতা হচ্ছে ঘরে বসে কাজ করার সুযোগ। কর্মক্ষেত্রের নমনীয়তার ফলে রাজধানী ঢাকার রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা জ্যামে বসে থাকতে হচ্ছে না ফ্রিল্যান্সদের। যার ফলে বাঁচানো যাচ্ছে মূল্যবান সময় ও শক্তি, সৃষ্টি হচ্ছে না হতাশার। ফলস্বরূপ, অনেক বাংলাদেশির জন্য ফ্রিল্যান্সিং ক্যারিয়ার হিসেবে অত্যন্ত জনপ্রিয় এক বিকল্প হয়ে উঠেছে, যা তাদের জীবনযাত্রার সুবিধায় নতুন এবং নমনীয় সুযোগ সরবরাহ করছে।
বাংলাদেশ সরকারের দ্রুত ডিজিটালাইজেশনের ফলে শহুরে এলাকায় সহজেই মিলছে ইন্টারনেট অ্যাক্সেস। ফ্রিল্যান্সিং ক্ষেত্রকে উন্নত করতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ ফলপ্রসূ হচ্ছে। অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইনস্টিটিউট (ওআইআই) অনুসারে, বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই বিশ্বে অনলাইন শ্রমের দ্বিতীয় বৃহত্তম সরবরাহকারী হয়ে উঠেছে। দেশের প্রায় ৬ লাখ ৫০ হাজার নিবন্ধিত ফ্রিল্যান্সারের মধ্যে প্রায় ৫ লাখ সক্রিয় ফ্রিল্যান্সার নিয়মিত কাজ করছে। বাংলাদেশের আইসিটি বিভাগের মতে, তাদের এই কাজের ফলে বছরে ১০০ মিলিয়ন ডলার আয় করছে দেশ।
ছবি : ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম
অনলাইন শ্রম সরবরাহকারী দেশের তালিকায় এক নম্বরে রয়েছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত। বিশ্বব্যাপী মোট ফ্রিল্যান্সারদের ২৪ শতাংশই ভারতীয় যেখানে বাংলাদেশিদের অংশ ১৬ শতাংশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১২ শতাংশ। বিভিন্ন দেশ ফ্রিল্যান্সিং সেবার বিভিন্ন সেক্টরের ওপর ফোকাস করে কাজ করছে। উদাহরণস্বরূপ, প্রযুক্তি ও সফ্টওয়্যার উন্নয়ন বিভাগ ভারতীয় ফ্রিল্যান্সারদের দখলে, যখন বাংলাদেশিরা বিক্রয় এবং বিপণন সহায়তা পরিষেবাদির শীর্ষ সরবরাহকারী।
ফ্রিল্যান্সিং : বেকারত্ব সমস্যার সমাধান
সাহায্য সংস্থা ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশের গবেষণা অনুযায়ী, বাংলাদেশের ৪ কোটি ৪০ লাখ যুবসমাজের প্রতি ১০ জনের একজন তরুণ বেকার। বাংলাদেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রতিবছর পাস করে বের হওয়া হাজার হাজার স্নাতকধারীরা শিক্ষাজীবন পার করে উপযুক্ত চাকরি খুঁজে পেতে ব্যর্থ হচ্ছে।
ফলস্বরূপ, দেশে শিক্ষিত বেকারত্বের হার দ্রুতগতিতে বাড়ছে। তবে, এই অল্পবয়সী বেকার তরুণেরা অনলাইনে সামান্য আইটি প্রশিক্ষণ নিয়েই অনলাইনে ফ্রিল্যান্সিং শুরু করতে পারেন। এভাবে, তারা শুধু নিজেদের জীবনযাপন করছে না বরং বৈদেশিক মুদ্রায় উপার্জন করে দেশের অর্থনীতিতেও অবদান রাখতে সক্ষম হচ্ছে।
কর্মক্ষেত্রে নারীদের সুযোগ
বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষিত নারীরাসহ অধিকাংশ মেয়েই তাদের পরিবারের যত্ন নেয়ার খাতিরে নিজেদের ক্যারিয়ারকে উৎসর্গ করে। ফ্রিল্যান্সিং যেহেতু বাড়িতে বসেই কাজের সুযোগ দেয়, সেহেতু অনেক বাংলাদেশি নারীদের জন্যেই ফ্রিল্যান্সিং পেশার বিকল্প হিসেবে পছন্দসই এক কর্মজীবন হয়ে উঠছে।
যেসব বাংলাদেশি নারীরা ঘরের মধ্যে থেকে গার্হস্থ্য ভূমিকা পালনের সংস্কৃতি থেকে বের হতে আগ্রহী হচ্ছেন, তাদের জন্য ফ্রিল্যান্সিং চাকরি একটি দুর্দান্ত সমাধান। এ দিকে, গবেষণায় দেখা গেছে যে, কাজের গুণগত মান অনুযায়ী, বাংলাদেশের নারী ফ্রিল্যান্সাররা ক্রমেই তাদের পুরুষ প্রতিপক্ষের চেয়ে বেশি বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করছে। ফ্রিল্যান্সিংয়ে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ার ফলে এই সেক্টরের ওপর আস্থা বাড়ছে দেশের সাধারণ মানুষের।
উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ ও সমাধান
আইসিটি সেবা সেক্টরের বিকাশের জন্য প্রতিটি জেলায় কমপক্ষে একটি হাই-টেক পার্ক তৈরি করা, কম খরচে প্রশিক্ষণ প্রদানের মতো বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগগুলো দেশটিকে গ্লোবাল আউটসোর্সিং বাজারে একটি গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হিসেবে উপস্থাপন করেছে।
তবুও, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই শিল্পের বিকাশে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ রয়েছে, তার মধ্যে বিদ্যুৎ বিভ্রাট অন্যতম। অবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের অভাব এখনও বাংলাদেশের একটি প্রধান সমস্যা। ফ্রিল্যান্সিং কাজ, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টের জটিল কোডিংয়ের মতো কাজে নিবিড় মনোযোগের প্রয়োজন, যা ঘন ঘন লোডশেডিংয়ের ফলে ব্যাহত হচ্ছে।
বাংলাদেশ ডিজিটালাইজেশনে উন্নত করলেও কিছু মৌলিক ক্ষেত্রে খুবই সমস্যা রয়েই গিয়েছে। এরমধ্যে উচ্চ গতিসম্পন্ন ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পরিষেবা অন্যতম। বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের ইন্টারনেট মূল্য অনেক বেশি আর দেশের গ্রামাঞ্চলে ফ্রিল্যান্সারদের জন্য কম মূল্যের ব্রডব্যান্ড সরবারহের অভাব একটি প্রধান সমস্যা। কিছু এলাকায় ব্রডব্যান্ড সংযোগ থাকলেও ধীরগতির ফলে ফ্রিল্যান্সাররা কাজের ক্ষেত্রে প্রায়ই সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে।
বিস্তরভাবে ফ্রিল্যান্সিং বাস্তবায়নের অন্য একটি প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে একটি সহজ পেমেন্ট সিস্টেমের অভাব। ফ্রিল্যান্সিং যেহেতু বিদেশি ক্লায়েন্টের সেক্টর, সেখানে ক্লায়েন্টদের কাছ থেকে অর্থপ্রাপ্তিতে একটি সহজ পেমেন্ট সিস্টেম আবশ্যক। এই দ্রুত বর্ধমান শিল্পের জন্য বাংলাদেশ সরকারের বিদেশি ক্লায়েন্টদের কাছ থেকে পেমেন্ট গ্রহণের ক্ষেত্রে জনপ্রিয় পেমেন্ট সিস্টেমগুলোকে আনয়ন বা নতুন কোনো উপায় চালু করা আবশ্যক।
ছবি : ব্যাসিস
ফ্রিল্যান্সিংয়ে নারীর অংশগ্রহণ ধীরে ধীরে বাড়লেও এখনও যথেষ্ট পর্যায়ে পৌঁছাতে পারেনি। বাংলাদেশের নারীদের এই পেশার দিকে ঝোঁকাতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ আবশ্যক হলেও তেমন কোনো উদ্যোগ নজরে আসেনি।
এসব প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও বাংলাদেশ বিশ্বে আউটসোর্সিং-এ এক উদীয়মান পরাশক্তির নাম। এশিয়ার কয়েকটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশই তুলনামূলক এক বিশাল যুবসমাজ রয়েছে। সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের মধ্যে প্রায় ৬৫ শতাংশেরই বয়স ২৫ বছরের কম। তবে, এই বিশাল তরুণ এবং শক্তিশালী জনসম্পদ থাকা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় জ্ঞানের অভাবে এখনও প্রতিযোগিতামূলক বৈশ্বিক বাজারটিতে পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ।
যদিও, গত কয়েক বছরে ক্যারিয়ার হিসাবে ফ্রিল্যান্সিং বাংলাদেশে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। কিন্তু, হাজার হাজার বাংলাদেশি তরুণকে এই সুযোগটিকে কাজে লাগানোর জন্য যথাযথ প্রশিক্ষণ ও সরকারি সহায়তা সরবারহ আবশ্যক।
বাংলাদেশ সরকারের এই বিশাল বেকার তরুণসমাজকে প্রযুক্তি-সচেতন কর্মী এবং আইটি-ভিত্তিক ফ্রিল্যান্সিংয়ে যুক্ত করা উচিত। আন্তর্জাতিক বাজারে এক উদাহরণ হিসেবে শীর্ষ ডিজিট্যাল বাংলাদেশ গড়ে তুলতে জনসম্পদকে কাজে লাগাতে হবে। আর এভাবেই, বাংলাদেশ সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশ উদ্যোগের আক্ষরিক অর্থে বাস্তবায়ন ঘটবে।
নিউজওয়ান২৪.কম/এমজেড