ঢাকা’র ইতিহাস (পর্ব-১)
সাতরং ডেস্ক
নিউজ ওয়ান২ ৪
প্রকাশিত : ০২:৩২ এএম, ১৬ এপ্রিল ২০১৯ মঙ্গলবার
ফাইল ফটো
ঢাকা (ইংরেজি: Dhaka; ১৯৮২ সালের পূর্বে Dacca নামে লেখা হত) বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন একটি শহর এবং বর্তমানে বাংলাদেশের রাজধানী।
খ্রিষ্টীয় অষ্টম শতাব্দীতে এ অঞ্চলে পাল রাজারা রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। পাল রাজারা এই দেশে ‘বার ভুঁইয়া’ নামে পরিচিত। তাদের অধীনে সামন্তরাজদের বলা হতো ভৌমিক। আর ভৌমিকদের অধিকৃত স্থান পরিচিতি পেত ‘ভূম’ বলে।
ঢাকার বিভিন্ন অঞ্চল যেমন: ফুলবাড়িয়া, রাজাঘাট, কোটবাড়ি, সেনাপাড়া প্রভৃতি স্থানে পালবংশীয় নৃপতিদের কীর্ত্তি কলাপের নিদর্শন আছে। যশোপাল ধামরাইয়ে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ‘মাধব বিগ্রহ’। যা যশোমাধব নামেই বেশি পরিচিত।
সুয়াপুরের নান্নার গ্রামের পশ্চিমে বাজাসন মৌজা। বাজাসন শব্দটি বজ্রসন শব্দের অপভ্রংশ বলেও অনুমান করা হয়ে থাকে। এই অঞ্চলের মাটি খনন করলে বৌদ্ধ নিদর্শন পাওয়া অসম্ভব নয় বলে মনে করেন ঐতিহাসিকরা। কথিত আছে, ঢাকা জেলার মধ্যে ভাওয়াল অঞ্চলেই বৌদ্ধধর্ম সবশেষ প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল।
অনুমান করা হয়, বৌদ্ধধর্মের আধিপত্য রোধ করার জন্যই হিন্দুরা ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে ৫১টি স্থানে ভৈরব ও শক্তি আরাধনার কেন্দ্রস্থল করেন। মহারাজ বল্লাল ভূপতি ছিলেন বৌদ্ধ-বিদ্বেষী। ঢাকেশ্বরী মন্দির তিনিই স্থাপন করেছিলেন বলে কথিত আছে।
পালবংশীয় শাসন শেষ হওয়ার পর ভাওয়ালের অন্তর্ভূক্ত রাজাবাড়িতে চণ্ডাল প্রতাপ ও প্রসন্ন দুই ভাই আধিপত্য বিস্তার করেছিলেন। কিন্তু তাদের উৎপীড়নে ভাওয়াল জনশূন্য হয়ে পড়েছিল। ব্রাহ্মণদের তারা ভয়ানক নির্যাতন করতেন। এই অঞ্চল শাসন করেছেন আরেক রাজা ‘থাইডা ডোস্কা’। অনুমান করা হয় তিনি ছিলেন তিব্বত দেশীয়।
বিক্রমপুরে বৌদ্ধদের আধিপত্য বিস্তৃত ছিল তা সর্বজনবিদিত। বিক্রমপুরের ইতিহাসপ্রণেতা শ্রীযুক্ত যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত লিখেছেন, সোপারঙ্গের গোসাই বাড়িতে যে অবলোকিতেশ্বর মূর্তি পাওয়া গেছে তা বিক্রমপুরের বৌদ্ধধর্ম প্রাধান্যের চিহ্ন।
পালবংশীয় নরপতিদের অধঃপতনের পর এই অঞ্চলে শাসনকার্য পরিচালনা করেন গাজীবংশীয়রা। মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা হওয়ার প্রথম দিকে গাজী বংশীয়রা পাধান্য লাভের আগ পর্যন্ত বিচারভার ন্যস্ত ছিল কাজীদের ওপর। কাজীরা সাভার গ্রামে বসবাস করতেন। তাদের নাম অনুসারেই নামকরণ হয়েছিল ‘কাজীর গাঙ্গ’ নদীর।
পূর্ব বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার প্রথমদিকে জগন্নাথ বণিক নানা রকম কাজে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন। কথিত আছে, তিনি আঠারো শত দেউল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং বহু যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেছিলেন। জগন্নাথের প্রতিষ্ঠিত দেউলগুলির ভগ্নাংশ জোড়াদেউল, গানাম, সুখবাসপুর দেওসার, সোনারঙ্গ প্রভৃতি গ্রামে দেখা গেছে। দেউলগুলো খনন করিলে বহু পুরাতত্ত্বের রহস্য উন্মোচন করা সম্ভব বলে ইতিহাসবিদরা মনে করেন।
ধলেশ্বরী নদী থেকে তালতলারখালে প্রবেশ পথের কাছেই ফেগুনা লারের মঠ। এই মঠ শ্যামসুন্দর রায় কর্তৃক তার মাতৃ শ্মশানোপরি প্রতিষ্ঠিত। ফেগুনাসারের যে অংশে এই মঠ সেই অংশ ‘শ্যাম রায়ের পাড়া’ নামে পরিচিত।
মঠের পশ্চিমে প্রাচীর বেষ্টিত দ্বিতল অট্টালিকা ও সিংহদরজার চিহ্ন বিদ্যমান আছে। শ্যমরায় ছিলেন শ্রীহট্টের (সিলেটের) নবাবের দেওয়ান। তিনি ছিলেন অতিথিসেবক ও ভক্তিমান। শ্যামরায়ের মায়ের চড়কপূজা চালু করেছিলেন।
রামপালের শাসনামলে তাঁতি, শাঁখারী ব্যবসায়ীদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন স্থান নির্দিষ্ট ছিল। পানহাটা (পানিহাটী), শাঁখারী দীঘি, পাইকপাড়া স্থানসমূহ রামপাল নগরীর অন্তর্ভূক্ত কলে অনুমান করা হয়। খ্রিষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দিতে রামপালের অধঃপতন সংঘটিত হয়। এই শতাব্দীর শেষ ভাগেও সোনারগাঁয়ে হিন্দু-রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত ছিল। চতুর্দশ শতাব্দীর শুরুর দিকে সোনারগাঁয়ে মুসলিম শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। সোনারগাঁ পূববঙ্গের রাজধানী হিসেবে পরিচিতি পায়। এই সময়ে সোনারগাঁর অতি সুক্ষ্ম ও শুভ্র মসলিন কাপড় সভ্যজগতে বিষ্ময়ের জন্ম দেয়, পরিচিত হয়ে ওঠে সোনারগাঁ। সোনারগাঁয়ের উকৃৎষ্ট বস্ত্র ও চাল ভারত বর্ষের বিভিন্ন স্থানে রফতানি হতো। একই সঙ্গে সিংহল, চীন, এমনকি ইউরোপেও রফতানি হতো।
বিদেশি পরিব্রাজকরা আরব ও ইউরোপ থেকে ভারতে আসতো তারপর সোনারগাঁও স্বচক্ষে দেখার জন্য আসতেন। এই সময়ে বাঙ্গালা দিল্লীশ্বরের অধীনতা ছিন্ন করে। বাঙ্গালাকে স্বাধীন ঘোষণা করে। এরপর প্রায় দুইশত বছর স্বাধীনতা রক্ষা করতে সমর্থ হয়।
খ্রিষ্টীয় পঞ্চদশ শতাব্দীর শুরুর দিকে ঢাকার নামও সোনারগাঁয়ের মতো প্রাধান্য পেতে শুরু করে। ষোড়শ শতাব্দির শেষদিকে মোগল সম্রাটের সেনা-সন্নিবেশ ঢাকায় সংস্থাপিত হয়। সপ্তাদশ শতাব্দিতে ঢাকা বাঙ্গালার রাজধানীতে পরিণত হয়। ঢাকার সুদৃঢ় দূর্গ থেকে সমগ্র বঙ্গ দেশ শাসিত হতো। আসাম, বিহার, চট্টগ্রাম ও উড়িষ্যা প্রদেশের বিদ্রোহ দমন করা হতো এবং প্রত্যন্ত প্রদেশের স্বাধীন রাজন্যবর্গকে পরাজিত করে দিল্লীর শাসনে প্রভাব বিস্তার করত। দিল্লীর সম্রাটের বংশধর ও প্রধান প্রধান আমির ওমরাহরা ভারতের অন্যান্য প্রদেশের শাসনকার্যে কৃতিত্ব ও নৈপূণ্য প্রদর্শন করে ঢাকার সুবাদারী পদ লাভ করতে পরলে গৌরবজনক মনে করতেন। ১৭১৭ খ্রিষ্টীয় মুর্শিদাবাদে রাজধানী স্থানান্তর করার পর ঢাকার জৌলুশ কমে যায়। চলবে...
নিউজওয়ান২৪.কম/আ.রাফি