পৃথিবীর দৃষ্টিনন্দন মসজিদগুলো
নিউজ ডেস্ক
নিউজ ওয়ান২ ৪
প্রকাশিত : ০৮:৫৪ এএম, ৪ ডিসেম্বর ২০১৮ মঙ্গলবার

ফাইল ছবি
মসজিদ 'মহান আল্লাহর ঘর'। সে অনুসারে ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা এই মসজিদের পবিত্রতা রক্ষা, মসজিদে ইবাদত বন্দেগিসহ যাবতীয় কাজে মসজিদের প্রতি নিবেদিত।
মসজিদকেন্দ্রিক সমাজব্যবস্থা ছিল মহানবী হজরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এর আমলে। বিশ্বের এখনো বেশ কয়েকটি দেশে মসজিদভিত্তিক সমাজ উন্নয়ন ও অন্যান্য কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। বাংলাদেশে সুলতানি ও মুঘল আমলের মসজিদ নির্মাণশৈলী অত্যন্ত সুন্দর ও প্রশংসনীয়।
বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে এখনো সুলতানি আমলের মসজিদ ও মুঘল আমলের মসজিদ প্রাচীন কীর্তি হিসেবে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পাঠকদের জন্য ইন্টারনেট ঘেঁটে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ দৃষ্টিনন্দন মসজিদগুলো সম্পর্কে সংক্ষিপ্তকারে বর্ণনা তুলে ধরা হলো।
(১) মসজিদ-আল-হারাম, সৌদি আরব:
ইসলামের সবচেয়ে পবিত্র স্থান, যা কাবাকে ঘিরে অবস্থিত। সৌদি আরবের মক্কা শহরে এর অবস্থান। ভেতরের ও বাইরের নামাজের স্থান মিলে মসজিদের বর্তমান কাঠামো প্রায় তিন লাখ ৫৬ হাজার ৮০০ বর্গমিটার (৮৮.২ একর)। মসজিদ আল হারামে মোট মিনারের সংখ্যা ৯টি এবং সর্বোচ্চ উচ্চতা ৮৯ মিটার (২৯২ ফুট)।
বর্তমানে প্রায় নয় লক্ষ মুসল্লী একসঙ্গে এই বৃহৎ মসজিদে নামাজ আদায় করতে পারেন। এ পর্যন্ত মোট চারবার এই মসজিদের সম্প্রসারণ কার্য পরিচালিত হয়। সর্বশেষ ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দে মসজিদ আল হারামের চতুর্থ সম্প্রসারণ কার্য শুরু হয় যা ২০২০ খ্রিষ্টাব্দ নাগাদ শেষ হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তৎকালীন বাদশাহ আবদুল্লাহ বিন আবদুল আজিজ মসজিদের ধারণ ক্ষমতা ২০ লক্ষে উন্নীত করার পরিকল্পনা করেন। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে বাদশাহ মারা যাওয়ার পর তার উত্তরসূরি সালমান বিন আবদুল আজিজ এই সম্প্রসারণ চালু রেখেছেন।
হজের সময় এখানে উপস্থিত হওয়া মানুষের জমায়েত পৃথিবীর বৃহত্তম মানব সমাবেশের অন্যতম। এই মসজিদের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো হল: কাবা শরীফ, হাজরে আসওয়াদ, মাকামে ইব্রাহিম, সাফা ও মারওয়া, জমজম কূপ (কথিত আছে, ফেরেশতা হজরত জিবরাঈল (আ.) এর পায়ের আঘাতে মুসলমানদের কাছে পবিত্র এই পানির কূপের সৃষ্টি হয়)।
(২) মসজিদে নববী, সৌদি আরব:
হজরত মুহাম্মদ (সা.) কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত মসজিদ, যা বর্তমান সৌদি আরবের মদিনা শহরে অবস্থিত। গুরুত্বের দিক থেকে মসজিদুল হারামের পর মসজিদে নববীর স্থান। হজরত মুহাম্মাদ (সা.) হিজরত করে মদিনায় আসার পর এই মসজিদ নির্মিত হয়। তিনি নিজে ব্যক্তিগতভাবে এই মসজিদের নির্মাণকাজে অংশ নিয়েছিলেন।
এটি পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ মসজিদ। এখানে অবস্থিত সবুজ গম্বুজটি খুবই গুরত্বপূর্ণ। এটি আয়েশা (রা.) এর বাড়ি ছিল। এখানে হজরত মুহাম্মাদ (সা.) ও তাঁর ইন্তেকাল পরবর্তী সময়ের দু'জন খলিফাকে দাফন করা হয়। ১২৭৯ খ্রিস্টাব্দে কবরের ওপর একটি কাঠের গম্বুজ নির্মিত হয়। এটি পরবর্তী সময়ে ১৫০০ শতাব্দীতে কয়েকবার এবং ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দে একবার পুনর্নির্মিত ও সৌন্দর্যবর্ধিত করা হয়। ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে প্রথম রঙ সবুজ করা হয়, ফলে এর নাম সবুজ গম্বুজ হয়েছে।
(৩) মসজিদুল আকসা, জেরুজালেম:
আল আকসা মসজিদ বাইতুল মুকাদ্দাস নামেও পরিচিত। জেরুজালেমের পুরনো শহরে এটি অবস্থিত। এটির সঙ্গে একই প্রাঙ্গনে কুব্বাত আস সাখরা, কুব্বাত আস সিলসিলা ও কুব্বাত আন নবী নামক স্থাপনাগুলো অবস্থিত। স্থাপনাগুলোসহ এই পুরো স্থানটিকে হারাম আল শরিফ বলা হয়।
এছাড়া স্থানটি 'টেম্পল মাউন্ট’ নামে পরিচিত এবং ইহুদি ধর্মে পবিত্র বলে বিবেচিত হয়। ইসলামের বর্ণনা অনুযায়ী হজরত মুহাম্মাদ (সা.) মিরাজের রাতে মসজিদুল হারাম থেকে আল আকসা মসজিদে এসেছিলেন এবং এখান থেকে তিনি ঊর্ধ্বাকাশের দিকে যাত্রা করে মহান আল্লাহর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
এটি ইসলামের তৃতীয় পবিত্রতম স্থান। বর্তমানে পুরনো শহর ইসরায়েলি নিয়ন্ত্রনে রয়েছে। তবে মসজিদটি জর্দানি বা ফিলিস্তিনি নেতৃত্বাধীন ওয়াকফর তত্বাবধানে রয়েছে।
(৪) দ্বিতীয় হাসান মসজিদ, মরক্কো:
মরক্কোর মাটিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা পানিতে ভাসমান দৃষ্টিনন্দন এই মসজিদের নাম গ্র্যাণ্ড মস্ক হাসান-২ বা দ্বিতীয় হাসান মসজিদ। একে ভাসমান মসজিদ বলার কারণ হচ্ছে, মসজিদটির তিন ভাগের এক ভাগ আটলান্টিক মহাসাগরের ওপর অবস্থিত। দূরের কোনো জাহাজ থেকে দেখলে মনে হয়, ঢেউয়ের বুকে যেন মসজিদটি দুলছে আর মুসল্লীরা যেন পানির ওপর নামাজ পড়ছেন।
মহাসাগরে ভাসমান এ মসজিদটি মরক্কোসহ সমগ্র আফ্রিকার সবচেয়ে বড় মসজিদ। ঝড়বৃষ্টির সময় ছাড়া প্রাকৃতিক আলো ও মুক্ত বাতাস প্রবেশ করায় মসজিদটির ছাদ তিন মিনিট পর পর খুলে যায়। ৩৩ ফুট সমান উচ্চতার সামুদ্রিক ঢেউ সামলে নেয়ার ব্যবস্থা আছে মসজিদটিতে। সমুদ্রের কোনো গর্জন শোনা যায় না মসজিদে। ২২.২৪ একর জায়গায় অবস্থিত এ মসজিদের মূল ভবনের সঙ্গে আছে সভাকক্ষসহ লাইব্রেরী, পবিত্র কোরআন শিক্ষালয়, অজুখানা।
প্রায় আড়াই হাজার পিলারের ওপর স্থাপিত এ মসজিদের ভেতরের পুরোটায়ই টাইলস বসানো। মসজিদ এলাকার আশপাশ সাজানো হয়েছে ১২৪টি ঝর্ণা ও ৫০টি ক্রিস্টাল ঝাড়বাতি দিয়ে। শুধু তাই নয়, কোথাও কোথাও এসব মোড়ানো হয়েছে স্বর্ণের পাত দিয়েও।
মসজিদটির মিনারের উচ্চতা ২১০ মিটার, যা পৃথিবীর মধ্যে সর্বোচ্চ উচ্চতার মিনার। ৬০ তলা ভবনের সমান এ মিনারের ওপর রয়েছে লেজার রশ্মি, যা নাবিকদের দেখিয়ে দেয় পবিত্র কাবা শরিফের পথ। ৩০ কিলোমিটার দূর থেকেও দেখা যায় এই লেজার রশ্মি। মরক্কোর বাদশাহ দ্বিতীয় হাসান মসজিদটি নির্মাণ করেন।
(৫) সুলতান ওমর আলী সাইফুদ্দিন মসজিদ, ব্রুনাই:
১৯৫৮ সালে ঐতিহাসিক ও দৃষ্টিনন্দন এই মসজিদ নির্মাণকাজ শেষ হয়। মসজিদটি ব্রুনাইয়ের রাজধানী বন্দর সেরি বেগাওয়ানে অবস্থিত। মসজিদটির প্রধান গম্বুজের বাইরের অংশ সম্পূর্ণ খাটি সোনা দিয়ে তৈরি।
পাঁচ একর জমির ওপর অবস্থিত ভেতরের অংশে একসঙ্গে তিনহাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। মসজিদটি নির্মাণে অত্যন্ত মূল্যবান গ্রানাইট, মার্বেল ও ক্রিস্টাল ব্যবহার করা হয়।
(৬) জহির মসজিদ, মালয়েশিয়া:
এটি মালয়েশিয়ার কেদাহ রাজ্যে অবস্থিত। জহির মসজিদ মালয়েশিয়ার সবচেয়ে প্রাচীন একটি মসজিদ। ১৯১২ সালে সুলতান তাজউদ্দিন মুকাররম শাহ'র ছেলে টুংকু মাহমুদের অর্থায়নে এই মসজিদের নির্মাণ কাজ শুরু হয়, যা ১৯১৫ সালে সমাপ্ত হয়। ইন্দোনেশিয়ার উত্তর সুমাত্রার আজিজি মসজিদের আদলে মূলত এই স্থাপত্য নির্মাণ করা হয়।
ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের কথা মাথায় রেখে এই মসজিদটিতে পাঁচটি গম্বুজ স্থাপন করা হয়। এই মসজিদের প্রাঙ্গনে বার্ষিক কোরআন তেলাওয়াত প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হয়। জহির মসজিদের নকশায় লক্ষ্য করা যায় মালয়েশিয়ান, ভারতীয় ও মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাব।
(৭) ফয়সাল মসজিদ, পাকিস্তান:
এটি পাকিস্তানের বৃহৎ মসজিদ, যেটি দেশটির রাজধানী ইসলামাবাদে অবস্থিত। মসজিদটি ১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। তুর্কি স্থপতি ভেদাত ডালোকে এর নকশা করেন। তৎকালীন সৌদি বাদশাহ ফয়সাল বিন আব্দুল আজিজ পাকিস্তানে মসজিদটি নির্মাণের ইচ্ছা পোষণ ও সহযোগিতা করেন। তাই তার নামে নামকরণ করা হয় মসজিদটি। মসজিদটির আয়তন ৪৩,২৯৫ বর্গমিটার। মসজিদটির চারকোণে চারটি মিনার রয়েছে যার প্রতিটির উচ্চতা ৮০ মিটার (২৬০ ফুট)। মসজিদটি দেখতে অনেকটা মরুভূমির বেদুইনদের তাঁবুর মতো।
সারা পৃথিবীতে এটি ইসলামাবাদের প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মসজদটির প্রধান এলাকায় প্রায় ৭৪,০০০ মানুষ এবং সংযুক্ত বৃহৎ এলাকাটিতে প্রায় ২,০০,০০০ মানুষ একসঙ্গে নামাজ পড়তে সক্ষম। ১৯৮৬ সাল থেকে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত মসজিদটি পৃথিবীর বৃহত্তম মসজিদ ছিল। পরবর্তীতে মরক্কোর হাসান-২ মসজিদ নির্মিত হলে 'ফয়সাল মসজিদ' তালিকায় নিজের প্রথম অবস্থানটি হারিয়ে ফেলে।
(৮) তাজ-উল মসজিদ, ভারত:
এটি ভারতের সর্ববৃহৎ মসজিদ; একইসঙ্গে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ এই মসজিদটি ভারতের ভোপালে অবস্থিত। মোগল সম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরের শাসনামলে বাকি মোহাম্মদ খানের স্ত্রী নবাব শাহজাহান বেগম কর্তৃক ১৮৪৪ সালে নির্মাণকাজ শুরু হলেও আল্লামা মুহাম্মাদ ইমরান খান নদভী আজহারি ও মাওলানা সাইয়েদ হাসমত আলী সাহেব ১৯৮৫ সালে এর নির্মাণকাজ শেষ করেন। মসজিদটিতে তিনটি গম্বুজ ও দুটি সুউচ্চ মিনার রয়েছে। মসজিদটির আয়তন ৪,০০,০০০ বর্গমিটার বা ৯৮ একর। ‘তাজ উল মসজিদ’ -এ ১,৭৫,০০০ জন মানুষ একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারে। অত্যন্ত কারুকার্যপূর্ণ এই মসজিদটি দেখতে বহু দূর-দূরান্ত হতে পর্যটকরা আসেন।
(৯) বাদশাহি মসজিদ, পাকিস্তান:
মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেব এই মসজিদ নির্মাণ করেন। ১৬৭১-১৬৭৩ সালের মধ্যে পাকিস্তানের লাহোরে এই মসজিদ নির্মিত হয়। সে সময়ে এটি ছিল বিশ্বের সর্ববৃহৎ মসজিদ। সামনের সুবিশাল চত্বরটিসহ মসজিদের আয়তন প্রায় দুই লাখ ছিয়াত্তর হাজার বর্গফুট। মসজিদটিতে দৃষ্টিনন্দন আটটি মিনার রয়েছে যার প্রতিটির উচ্চতা ১৯৬ ফুট। আরো রয়েছে তিনটি গম্বুজ। লাল মার্বেল পাথর দিয়ে তৈরি মসজিদটি এতটাই সুদর্শন যে ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইটে এটি সহজেই স্থান করে নিয়েছে।
মসজিদটির রাজকীয় সিঁড়ির বাইশটি ধাপ পেরিয়ে তারপর মূল ফটকে পৌঁছতে হয়। আর মূল ফটকে ক্যালিওগ্রাফিতে মসজিদটির নাম লেখা আছে 'মসজিদ আবুল জাফর মহিউদ্দিন মোহাম্মদ আলমগীর বাদশাহ গাজী'। ভেতরে আর বাইরে মিলে সুবিশাল এই মসজিদটির ধারণ ক্ষমতা প্রায় এক লাখ মুসল্লি!
(১০) সুলতান মসজিদ, সিঙ্গাপুর:
এটিকে সিঙ্গাপুরের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মসজিদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মসজিদটি নির্মাণলগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত অপরিবর্তিত অবস্থায়ই রয়ে গেছে, অর্থাৎ যেভাবে মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছিল, ডিজাইনে তার কোনো মৌলিক পরিবর্তন আনা হয়নি। এর নির্মাণ কাজ শুরু হয় ১৮২৪ সালে এবং শেষ হয় ১৮২৬ সালে। সিঙ্গাপুরের বুগিস বাস স্টেশনে নেমে পূর্বে রাস্তা পার হলেই আরব স্ট্রিট। এই স্থান কামপোং গ্লাং নামেও পরিচিত।
দূর থেকেই দৃষ্টি কেড়ে নেবে মসজিদের সোনালী গম্বুজ,আর গম্বুজকে ঘিরে চারটি মিনার। সিঙ্গাপুরের ২০০ বছরের পুরনো মসজিদটির গঠনাকৃতি অসাধারণ।এর চাকচিক্য আর আভিজাত্য পর্যটকদের আকর্ষণ করে। তাই সিঙ্গাপুরে আসলে ২০০ বছরের পুরনো এ মসজিদ দেখতে ভোলেন না পর্যটকরা।