বেড়েছে রসনাবিলাস, বড় হচ্ছে ব্র্যান্ডেড মসলার বাজার
নিজস্ব প্রতিবেদক
নিউজ ওয়ান২ ৪
প্রকাশিত : ০১:১২ পিএম, ২১ নভেম্বর ২০১৮ বুধবার
ফাইল ছবি
আর্থিক উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের রসনাবিলাসও বেড়েছে। কিন্তু মজাদার রান্নার অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ মসলা বাটতে এখন আর রাজি নন রাঁধুনিরা। ফলে বাটা মসলার পরিবর্তে রান্নাঘরে স্থান করে নিয়েছে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্রক্রিয়াজাত মসলা। ভোক্তার আগ্রহ বাড়ায় দিন দিন বড় হচ্ছে এসব মসলা পণ্যের বাজার। বিভিন্ন গবেষণার তথ্য বলছে, দেশে প্রতি বছর গড়ে ১৫ শতাংশ হারে বাড়ছে ব্র্যান্ডেড গুঁড়া মসলার বাজার ।
দেশের মসলা বাজারের সার্বিক পরিস্থিতি জানতে বাংলাদেশ এগ্রো-বেইজড প্রডাক্ট প্রডিউসারস অ্যান্ড মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশন ও খাতসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের তথ্যের পাশাপাশি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস), কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই), বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইবিএল সিকিউরিটিজসহ মসলার বাজার নিয়ে বেশকিছু গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য পর্যালোচনা করা হয়েছে। সবগুলো তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, বর্তমানে দেশে মসলার বাজারের আকার প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত মসলার বাজার ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার। আর নন-ব্র্যান্ডেড মসলার বাজারের আকার ১০ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। নন-ব্র্যান্ডেড মসলার মধ্যে খোলাবাজারে বিক্রি করা মসলা ছাড়া বিদেশ থেকে আমদানিকৃত মসলাও রয়েছে। তাছাড়া স্কয়ার ও প্রাণের মতো কিছু প্রতিষ্ঠান বিদেশেও প্রক্রিয়াজাত মসলা রফতানি করছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যানুসারে, ২০০৯-১০ অর্থবছরে দেশে ২২ লাখ ৯৩ হাজার টন মসলা জাতীয় ফসল উৎপাদন হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৬-১৭ অর্থবছরে উৎপাদন ৩৫ লাখ টন দাঁড়িয়েছে। এর বাইরে ২০১৬-১৭ হিসাব বছরে বিদেশ থেকে ২৮ কোটি ৮০ লাখ ডলারের মসলা আমদানি হয়েছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে। যদিও ২০০৯-১০ অর্থবছরে বিদেশ থেকে আমদানি হয়েছিল ১০ কোটি ৯০ লাখ ডলারের মসলা। স্থানীয় পর্যায়ে মসলার উৎপাদন ও বিদেশ থেকে আমদানির তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, প্রতি বছরই দেশে মসলার ব্যবহার বাড়ছে।
বর্তমানে দেশের মসলার বাজারে রাঁধুনী, প্রাণ, বিডি, আরকু, এসিআই পিওর, রয়েল টাইগার, রানীসহ আরো বেশকিছু ব্র্যান্ডের গুঁড়া মসলা পাওয়া যায়। এর মধ্যে বাজারে শীর্ষে অবস্থানে রয়েছে স্কয়ার ফুড অ্যান্ড বেভারেজের ব্র্যান্ড রাঁধুনী। রাঁধুনীর পরই বেশি বিক্রীত ব্র্যান্ড হচ্ছে প্রাণ ফুডসের প্রাণ গুঁড়া মসলা। বিডি ফুডসের ব্র্যান্ড বিডি প্রক্রিয়াজাত গুঁড়া মসলা তৃতীয় এবং লালমাই ফুড প্রডাক্টস লিমিটেডের ব্র্যান্ড আরকু চতুর্থ অবস্থানে আছে।
জানা গেছে, ২০০১ সালে বাজারে রাঁধুনী নামে প্রক্রিয়াজাত গুঁড়া মসলা বাজারে নিয়ে আসে স্কয়ার ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেড। ব্র্যান্ডের গুঁড়া মসলার বাজারের ৬৬ শতাংশই এখন রাঁধুনীর দখলে। বর্তমানে রাঁধুনী ব্র্যান্ডের হলুদ, মরিচ, ধনিয়া, জিরা ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের মিক্সড মসলা যেমন— গরম মসলা, গরুর মাংসের মসলা, মুরগির মাংসের মসলা, মেজবানি গরুর মাংসের মসলা, মিট কারি মসলা, রোস্ট মসলা, বিরিয়ানি মসলা, তেহারির মসলা, কাবাবের মসলা, চটপটি মসলা, মাছের মসলা, পাঁচফোড়ন ইত্যাদি বাজারজাত করছে স্কয়ার। দেশের পাশাপাশি বিদেশের বাজারেও মসলা রফতানি করছে প্রতিষ্ঠানটি।
জানতে চাইলে স্কয়ার ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের সিনিয়র মার্কেটিং ম্যানেজার ইমতিয়াজ ফিরোজ বলেন, দেশের মসলার বাজারের ১০ শতাংশ ব্র্যান্ডের দখলে। এখনো অধিকাংশ মানুষ নন-ব্র্যান্ডের খোলা গুঁড়া মসলা ব্যবহার করছে। তবে আগের তুলনায় মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ছে। ফলে অনেকেই এখন খোলা মসলার পরিবর্তে ব্র্যান্ডের মসলা ব্যবহারের দিকে ঝুঁকছে। মসলার বাজারে প্রচুর সম্ভাবনা রয়েছে। তবে এক্ষেত্রে পণ্যের গুণগতমান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
প্রাণ ফুডসের ব্র্যান্ড প্রাণ গুঁড়া মসলার বাজারে আসে ২০০৩ সালে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির দখলে রয়েছে ১৯ শতাংশ বাজার। হলুদ, মরিচ, ধনিয়া, জিরা ছাড়াও আদা ও রসুনের পেস্ট মসলা, কাচ্চি বিরিয়ানি ও তেহারি মসলা, মাংসের মসলা, মুরগির মাংসের মসলা, বোরহানি মসলা, আচারের মসলা, চটপটি মসলাসহ আরো বেশকিছু ধরনের মসলা রয়েছে প্রাণের। দেশের বাজারের পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্য ও ভারতেও মসলা রফতানি করছে প্রাণ।
প্রক্রিয়াজাত গুঁড়া মসলার বাজারে বিডি ফুডসের দখলে রয়েছে ৭ শতাংশ। প্রতিষ্ঠানটি হলুদ, মরিচ, ধনিয়া, জিরা ছাড়াও কারি পাউডার, তন্দুরি চিকেন মসলা, বিফ কারি মসলা, ফার্মের মুরগির মসলা, খাসির মাংসের মসলা, গরম মসলা, পাঁচফোড়ন ও মাছের মসলা বাজারজাত করছে।
লালমাই ফুড প্রডাক্টস লিমিটেডের ব্র্যান্ড আরকুর দখলে রয়েছে ৩ শতাংশ বাজার। প্রতিষ্ঠানটি হলুদ, মরিচ, ধনিয়া, জিরা ছাড়াও আরো বেশকিছু ধরনের মসলা বাজারজাত করছে।
এসিআই ফুডস লিমিটেডের ব্র্যান্ড পিওর নামে বাজারে হলুদ, মরিচ, ধনিয়া, জিরা ছাড়াও মিট কারি মসলা ও গরম মসলা বাজারজাত হচ্ছে।
এ বিষয়ে এসিআই কনজিউমারের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ আলমগীর বলেন, রান্নার সময় কমানো, খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন, সহনীয় দামে ভালো পণ্যের সহজলভ্যতার কারণে প্যাকেটজাত মসলার বাজার সম্প্রসারণ হচ্ছে। ক্রেতারাও এসব পণ্যে আস্থা আনতে পারছেন। এসিআই মসলা জাতীয় পণ্যের গুণগত মান ও আন্তর্জাতিক মানের মোড়কজাত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মসলা বিপণন করছে। আমার পরিবারে যেসব পণ্য ব্যবহার করতে পারব, সে পণ্যই ক্রেতাদের দিয়ে থাকি। পণ্যের মূল্য নির্ধারণেও ভোক্তাদের ক্রয়ক্ষমতার বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া হয়। এজন্য বাজার প্রবৃদ্ধির চেয়ে আমাদের পণ্যের প্রবৃদ্ধি এখনো বেশি।
বাজারে রানী ব্র্যান্ড নামে গুঁড়া মসলা বিক্রি করছে পারটেক্স স্টার গ্রুপ। তাছাড়া সিলেট অঞ্চলে জননী মসলা মিলসের ব্র্যান্ড রয়েল টাইগার মসলার বেশ জনপ্রিয়তা রয়েছে।
দেশে প্রক্রিয়াজাত মসলার বাজার প্রবৃদ্ধি সম্পর্কে বাংলাদেশ এগ্রো-বেইজড প্রডাক্ট প্রডিউসারস অ্যান্ড মার্চেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের জেনারেল সেক্রেটারি কাজী গোলাম আলী সুমন বলেন, প্রক্রিয়াজাত গুঁড়া মসলার বাজার ক্রমেই বড় হচ্ছে। আগে ব্র্যান্ডের মসলা ব্যবহারের প্রবণতা কেবল শহরাঞ্চলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও বর্তমানে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের মানুষ বিভিন্ন ব্র্যান্ডের প্রক্রিয়াজাত গুঁড়া মসলা ব্যবহার করছে। তাছাড়া গুঁড়া মসলার বাজারে এখন অনেক ধরনের বৈচিত্র্য এসেছে। প্রচলিত গুঁড়া মসলার বাইরেও বিভিন্ন ধরনের পেস্ট মসলাও বাজারজাত করছে বেশকিছু প্রতিষ্ঠান। ফলে মানুষের মধ্যে ব্র্যান্ডের মসলার জনপ্রিয়তা বাড়ছে।
বড় করপোরেটদের প্রক্রিয়াজাত গুঁড়া মসলার বাজারের বাইরে সুপারশপভিত্তিক কিছু মাঝারি ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা (এসএমই) প্রতিষ্ঠানও বাজারে গুঁড়া, পেস্টসহ বিভিন্ন ধরনের মসলা বাজারজাত করছে। বর্তমানে সুপারশপভিত্তিক এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলোর বাজার রয়েছে ৬০-৭০ কোটি টাকার। এসএমইভিত্তিক এ রকম কয়েকটি প্রক্রিয়াজাত মসলা বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান হচ্ছে— লেন্স, পিক অ্যান্ড প্যাক, বেস্ট ও হাইকো। এছাড়া রয়েছে বিটিএমই ও আহমেদ পেস্ট মসলা।
এসএমই প্রতিষ্ঠান লেন্স ট্রেডিং ২০১৬ সালে রাজধানীর গুলশানের ইউনিমার্ট মেগাশপে তাদের উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত শুরু করে। সুপারশপ স্বপ্নতেও প্রতিষ্ঠানটির পণ্য বিক্রি হচ্ছে। লেন্স ব্র্যান্ডের নামে প্রতিষ্ঠানটি হলুদ, মরিচ, ধনিয়া, জিরা ছাড়াও কালো গোলমরিচের গুঁড়া, গরম মসলা, দারচিনির গুঁড়া, মরিচের ফাঁকি, আদার গুঁড়া, রসুনের গুঁড়াসহ ৪১ ধরনের গুঁড়া মসলা বাজারজাত করছে। তাছাড়া তারা ৫০ ধরনের আস্ত প্যাকেটজাত মসলাও বাজারজাত করছে।
এ বিষয়ে লেন্স ট্রেডিংয়ের মহাব্যবস্থাপক মো. মনিরুজ্জামান বলেন, আমরা স্বল্প পরিসরে প্যাকেটজাত মসলা বাজারজাত শুরু করেছি। ইউনিমার্ট ও স্বপ্নের মতো সুপারশপগুলোতে আমাদের পণ্য জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এ ধরনের সুপারশপে সাধারণত মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত ভোক্তারা বাজার করে থাকে। আমাদের প্রক্রিয়াজাত পণ্যের গুণগতমান ভালো হওয়ার কারণে ভোক্তারা আমাদের ওপর আস্থা রাখছেন। বিদেশী কিছু প্রতিষ্ঠান আমাদের কাছ থেকে পণ্য নিতে চেয়েছিল। কিন্তু বড় আকারের পণ্য সরবরাহের সক্ষমতা না থাকায় আমরা রফতানি করতে পারিনি। তবে আশা করছি, ধীরে ধীরে আমাদের ব্যবসা বড় হবে এবং দেশের বাজারের পাশাপাশি বিদেশেও রফতানি করতে পারব।
নিউজওয়ান২৪/এমএস