বিচিত্র যত সমাধিক্ষেত্র
সাতরং ডেস্ক
নিউজ ওয়ান২ ৪
প্রকাশিত : ০৯:৫১ পিএম, ৭ নভেম্বর ২০১৮ বুধবার
ফাইল ছবি
বিজ্ঞান যতই উন্নত হোক না কেন এখন পর্যন্ত মানুষকে চিরঞ্জীব করতে পারেনি। মৃত্যু মানুষের জীবনের চিরন্তন এক সত্য। প্রতিটি মানুষকে গ্রহণ করতে হয় মৃত্যুর স্বাদ। মৃত্যু পরবর্তী যে সমাধি রীতি তা দেশ, সংস্কৃতি ও ধর্ম ভেদে ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। এমনই কিছু সমাধির কথা তুলে ধরা হবে যা আমাদের কাছে খুব অদ্ভুত হলেও, নিজ নিজ সংস্কৃতিতে এগুলো খুবই সাধারণ।
প্লেইন অব জারস:
লাওসের জিয়েং খোউয়াং প্রদেশের প্রাচীন এই নিদর্শনটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি অন্যতম রহস্যময় প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। প্রদেশটিতে এরকম প্রায় ৯০টি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রয়েছে, যেখানে এ রকম দৃশ্য পাওয়া যায়। বিশাল এক সমতল ভূমি জুড়ে রয়েছে অসংখ্য বিশাল আকৃতির পাথরের তৈরি কৌটো বা জার। আর এ নিদর্শনগুলোর নাম দেয়া হয়েছে ‘দ্য প্লেইন অব জারস’। নিদর্শনগুলো দেখতে কুয়ার মত হওয়ায় প্রথমে ধারণা করা হত এগুলোতে বৃষ্টির পানি জমিয়ে রাখা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে ১৯৩০ সালের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, কবর দেয়া সংক্রান্ত কোনো আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করা হতো এসব স্থাপনায়।
প্রত্নতত্ত্ববিদ এবং ইতিহাসবিদগণের মতে, এই জারগুলো ব্যবহার করা হতো মৃতদেহ সৎকার অথবা সৎকারের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য। ধারণা করা হয় বিশাল আকৃতির এই জারে বিভিন্ন উপাদানের সঙ্গে প্রথমে মৃতদেহ সংরক্ষণের জন্য রেখে দেয়া হত এবং আস্তে আস্তে তা কঙ্কালে পরিণত হলে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হত। ধারণা করা হয়, প্রায় তিন হাজার বছর পুরানো এই স্থাপনাগুলো।এগুলো নির্মাণে ব্যবহার করা হয় বেলেপাথর, চুনাপাথর, গ্রানাইটজাতীয় বিভিন্ন পদার্থ। বেশিরভাগই নির্মিত হয়েছে বেলেপাথর দিয়ে। কুয়াসদৃশ এ স্থাপনাগুলোর সবচেয়ে লম্বাটির উচ্চতা ৯ ফুট।
লা সেমিট্রি দেস চিয়েনস:
পর্যটকদের জন্য এটি প্যারিসের অন্যতম আকর্ষণীয় কেন্দ্র। কেননা এটি পোষা প্রাণীদের সবচেয়ে পুরনো সমাধিক্ষেত্র। সমাধিক্ষেত্রটি প্যারিসর দক্ষিণপশ্চিমে অবস্থিত। এর বিশেষত্ব হচ্ছে এই সমাধিস্থলটি শুধুমাত্র মানুষের আদরের পোষা প্রাণীদের সমাধির জন্য ব্যবহৃত হয়। “লা সেমিট্রি দেস চিয়েনস” কথাটির অর্থ কুকুরদের কবরস্থান। তবে এর শুরুটি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন এক উদ্দেশ্যে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে নিহত হওয়া সকল পোষা বা সামরিক কুকুরদের স্মরণে এটি তৈরি হয়।
এসব কুকুর ছিল সামরিক বাহিনী দ্বারা বিশেষভাবে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যুদ্ধ পারদর্শী কুকুর। এই কবরস্থানেই রয়েছে প্রথম বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ের আলোচিত নিহত কুকুর “ব্যারি” এর সমাধিসৌধ। ব্যারিও ছিল সামরিক বাহিনীর প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত একটি কুকুর। যে চল্লিশ আহত মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছিল এবং একচল্লিশতম প্রাণ যে ছিল একটি ছোট্ট শিশু, তাকে বাঁচাতে গিয়ে সে নিজে মারা যায়। লা সেমিট্রি দেস চিয়েন্স এ ব্যারির একটি পাথরের মূর্তি রয়েছে যাতে সে তার পিঠে একটি বাচ্চাকে বহন করে চলছে। কিন্তু বর্তমানে এটি আর কুকুরদের জন্য নির্দিষ্ট নেই। সব ধরণের পোষা প্রাণী বিড়াল, খরগোশ এমনকি ঘোড়া ও পোষা বানরদেরও সমাধিস্থ করা হচ্ছে।
ওকুনইন সমাধিক্ষেত্র:
ওকুনইন কবরস্থান কোয়া সান নামে জাপানের একটি প্রাচীন গ্রামে অবস্থিত। ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাতে যেসব পবিত্র স্থান যুক্ত হয়েছে তার মধ্যে একটি অন্যতম তীর্থস্থান। এটি অনুলিপিকৃত কেআই মাউন্টেন রেঞ্জের অনেকগুলো পবিত্র স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম। নানা কারণে এটি মানুষের কাছে একটি রহস্যময় ও আকর্ষণীয় স্থান। এর প্রধান কারণ হচ্ছে সমাধিসৌধগুলোর আকৃতি। অন্যান্য সব সমাধিক্ষেত্রগুলোতে কবরগুলো থাকে সারিবদ্ধভাবে এবং দেখতে একইরকম হয়ে থাকে। তবে অন্যান্য কবরস্থানগুলোর সঙ্গে কিন্তু ওকুনইনের পার্থক্য এখানেই।
এখানে বিভিন্ন মানুষের কবরের আকৃতি বিভিন্নরকম হয়ে থাকে। আর কার কবর কেমন হবে তা নির্ভর করে মৃত ব্যক্তির পেশার উপর। স্পেসশিপ, গাড়ি, কাপ এমনকি পোকার আকারের কবর রয়েছে। যার কবর দেখতে পোকার মতো তিনি ছিলেন একটি কীটনাশক প্রস্তুতকারী কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা। তাছাড়া এখানে রয়েছে জিযো বোধিসত্ত্বভা এর পাথরের মূর্তি। তার গায়ে পানি ছিটিয়ে সকলে মৃতের আত্মার শান্তি কামনা করে। আরো রয়েছে একটি ছোট্ট খাঁচার ভেতর “মিরুকু স্টোন” নামক একটি পাথর। যা উত্তোলন করে মানুষ নিজেদের মানদণ্ড পরীক্ষা করে। বলা হয়ে থাকে, যার হৃদয় যত নির্মল, তার কাছে এই পাথর তত হালকা।
এই সমাধিক্ষেত্রটি পবিত্র হওয়ার আরেকটি বড় কারণ হচ্ছে, এখানে শায়িত আছেন কোবো দাইশি, যিনি হলেন ষষ্ঠ শতাব্দীর শিনগো বৌদ্ধদের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি শায়িত আছে বলতে এখানে তার কোনো সমাধির কথা বলা হয়নি। বলা হয়ে থাকে যে তিনি এখানে এক গুহায় ঘুমিয়ে আছেন এবং জেগে উঠবেন তখন, যখন স্বয়ং গৌতম বুদ্ধ ভবিষ্যতে আবার ফিরে আসবেন। মানুষজন তাকে শ্রদ্ধা করে তার গুহার সামনে খাবার রেখে আসে।
গ্রিক রেভেন্যান্ট সমাধিক্ষেত্র:
প্রাচীন গ্রিকরা বিশ্বাস করতো মৃতরা পৃথিবীতে মৃত্যুর পর ঘুরে বেড়ায় ও অশুভ কাজ করে বেড়ায়। এদের মূলত গ্রিকরা জোম্বি বা ভ্যাম্পায়ার বলে বিশ্বাস করতো। সিসিলি গ্রিকের অন্তর্ভুক্ত একটি শহর ছিল যা বর্তমানে ইতালিতে অবস্থিত। সেখানকার একটি গ্রীক নেক্রোপলিসে ৩ হাজার কঙ্কাল খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, কিছু কঙ্কাল পাওয়া যায় যাদের মাথা ও পা ভারী পাথর দিয়ে চাপা দেয়া ছিল। ১৯৮০ সনের দিকে, যখন এই সমাধিক্ষেত্রটি আবিষ্কৃত হয়, তখন প্রত্নতত্ত্ববিদগণ বুঝতে পারেননি যে কেন তাদের পাথরচাপা দেয়া হয়েছিল।
সম্প্রতি, তবে কিছুদিন আগে এক প্রত্নতাত্ত্বিকের গবেষণায় এর আসল কারণ বের হয়ে আসে। সেখানে যে সকল কঙ্কাল পাওয়া গিয়েছিল তাদের কঙ্কালগুলো পরীক্ষা করে দেখা যায় যে প্রত্যেকটি কঙ্কালের শারীরিক বৃদ্ধি অস্বাভাবিক ছিল। অর্থাৎ জীবিত অবস্থায় ছিল তারা ছিল শারীরিক প্রতিবন্ধী। তখনকার মানুষ এই সকল প্রতিবন্ধকতা মেনে নিতে পারতো না। তারা ভাবতো এরা ডাইনি বা পিশাচ। এই সকল বিকলাঙ্গ মানুষ হচ্ছে রেভেন্যান্ট, অর্থাৎ যারা মৃতদের জগত হতে জীবিত হয়ে ফিরে এসেছে। তাই তারা সেই সকল প্রতিবন্ধীদের মৃত্যুর পর পাথর চাপা দিয়ে রাখতো যাতে তারা আর জীবিতদের মাঝে ফিরে আসতে না পারে। অনেকগুলো পাথরচাপা কঙ্কালের সঙ্গে একটি বাচ্চার কঙ্কাল ও ছিল।
নিউজওয়ান২৪/এএস