ওসি বললেন: ট্রাফিক পুলিশ এ বিষয়ে ভালো তথ্য দিতে পারবে
দেলোয়ার হোসেন, স্টাফ রিপোর্টার
নিউজওয়ান২৪.কম
প্রকাশিত : ০২:১৩ পিএম, ২৪ জুলাই ২০১৬ রোববার

রেকারে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে অবৈধ ইজিবাইক-ইঞ্জিনরিক্সা -ফাইল ফটো
ঢাকা: রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশ ফের ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ও অটোরিকশায় সয়লাব হয়ে গেছে। উচ্চ আদালত ও মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে সংঘবদ্ধ একটি চক্রের মদদে নিষিদ্ধ এসব যান অবাধে চলাচল করছে পাড়া-মহল্লা, অলিগলি ছাপিয়ে সড়ক-মহাসড়ক।
প্রায় ক্ষেত্রই এসব বাইেকর ব্যাটারি চার্জ করা হেচ্ছ অবৈধ বিদ্যুৎ সংযোগ থেকে। এতে করে একদিকে বৈধ গ্রাহকরা যেমন পড়ছেন অযাচিত লোডশেডিংয়ে অপরদিকে সরকার হারাচ্ছে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব।
এক হিসেবে দেখা গেছে, অবৈধ এসব ইজিবাইক ও ইঞ্জিনরিক্সায় প্রায় ১৫ লাখ চার্জার ব্যাটারি ব্যবহার করা হচ্ছে। এসব ব্যাটারি দিয়ে দিনভর কাজ শেষে রাতভর চার্জ দেয়া হচ্ছে। ফলে ১৫ লাখ চার্জার ব্যাটারিতে চার্জ দিতে প্রায় ৫শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হচ্ছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, কোনো প্রকার নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই খোদ ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় প্রায় ৭৫ হাজার ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ও অটোরিকশা চলাচল করছে।
অবৈধ এসব যানবাহনে ব্যবহৃত চার্জার ব্যাটারি প্রতিদিন সাড়ে ৪শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ গিলে খাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সূত্র জানায়, সরকারি অনুমোদন ছাড়াই অবৈধ এসব যানবাহন অবাধে প্রশাসনের চোখের সামনে প্রকাশ্যেই দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সারাদেশের পাড়া-মহল্লা, অলিগলিসহ সড়ক-মহাসড়ক। বেআইনি এসব যানবাহনের সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলছে। অনুমোদনহীন বাহনগুলো চলেও বেপরোয়া গতিতে আর নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই। ফলে ঘটাচ্ছে দুর্ঘটনা। প্রতিনিয়ত বাড়ছে হতাহতের সংখ্যা।
চার্জার ব্যাটারিচালিত ৩ চাকার এসব ইজিবাইক ও ইঞ্জিনরিক্সা (ইঞ্জিনযুক্ত রিক্সা) গত কয়েক বছর ধরেই সারাদেশেই চলাচল করছে।
সূত্র জানায়, গতবছর সরকারিভাবে দেশের সবকটি রাস্তা থেকে এসব বাহন পর্যায়ক্রমে তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হলেও আজও তা বাস্তবায়ন হয়নি। ইজিবাইক ও ইঞ্জিনরিক্সা নামে পরিচিত এই বাহন সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে বিপুল পরিমান বিদ্যুৎ চুরির অভিযোগ রয়েছে।
এ ব্যাপারে বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ জানায়, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর ৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করা হলেও এখনো লোডশেডিং সহনীয় পর্যায়ে আনা সম্ভব হয়নি। এ সমস্যা দূর করতে সরকারিভাবে প্রতিদিন সন্ধ্যা ৬টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত বিভিন্ন শিল্প-কারখানায় এবং বিকেল ৩টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সকল সিএনজি ফিলিং স্টেশনে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
বিদ্যুৎ বিভাগ আরও জানায়, ঢাকাসহ সারাদেশে নিষিদ্ধ প্রায় ৩ লাখ ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ও অটোরিকশা প্রতিদিন চলাচল করছে। এতে বিদ্যুৎ বিভাগের প্রায় সাড়ে ৪শ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ খরচ হচ্ছে। এসব বিদ্যুতের বেশিরভাগ অংশই ব্যবহার করা হচ্ছে অবৈধভাবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিদ্যুৎ বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, ঢাকাসহ সারাদেশেই বিধি-বহির্ভূতভাবে গড়ে উঠেছে রিক্সার গ্যারেজ। এসব গ্যারেজে বাণিজ্যিকভাবে বিদ্যুৎ সংযোগ দেওয়া হলেও বাইপাস ও বিকল্প উপায়ে বিদ্যুৎ সংযোগ করে অবৈধভাবে রাতের আঁধারে নিষিদ্ধ ইজিবাইক ও ইঞ্জিনরিক্সায় ব্যবহৃত চার্জার ব্যাটারিতে চার্জ দিয়ে লাখ লাখ টাকার বিদ্যুৎ চুরি করে নিচ্ছে সংশ্লিষ্ট অসাধু একটি চক্র।
এসব দমনে সংশ্লিষ্ট এলাকার বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ বিভিন্ন গ্যারেজ চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে চাইলেও শাসক দলের পরিচয়ধারী অসাধু নেতাকর্মীদের কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না।
সরকারিভাবে এসব যানবাহন চলাচলের ক্ষেত্রে কোনো ধরণের রুট পারমিট দেওয়া না হলেও সংশ্লিষ্ট এলাকার থানা পুলিশ ও নেতাকর্মীদের ম্যানেজ করে মোটা অংকের উৎকোচের বিনিময়ে মালিক-চালকরা অবাধে এসব যানবাহন রাস্তায় নামাচ্ছেন। এ তথ্য জানিয়েছেন লালবাগের নবাবগঞ্জ সেকশন বেড়িবাঁধ ঢাল টু নিউমার্কেট রুটে চলাচলরত ইজিবাইক রুটের লাইনম্যান পারভেজ।
তিনি বলেন, লালবাগের নবাবগঞ্জ সেকশন ঢাল টু নিউমার্কেট রুটে প্রতিদিন পালাক্রমে প্রায় ১১০টি ইজিবাইক চলাচল করে। প্রতিটি ইজিবাইক চলাচলের ক্ষেত্রে নবাবগঞ্জ সেকশন পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ (আইসি) এসআই আনিসুল ইসলামকে দৈনিক ১১শ টাকা করে প্রতিমাসে ৩৩ হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। নিয়মিত চাঁদার টাকা না দিলে নড়েচড়ে বসেন ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আনিসুল ইসলাম। তখন আইনের বিধি দেখিয়ে অবৈধ এসব যান চলাচল বন্ধ করে দেন। নিয়মিত তাকে টাকা দেয়া হলে অবৈধ এসব যান চলাচল বৈধ হয়ে যায়। এছাড়াও তার বিরুদ্ধে রয়েছে নানা অনিয়মের অভিযোগ।
তিনি আরও জানান, কামরাঙ্গীরচরে শাসক দলের দাপুটে এক ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও থানার ওসির মদদে কামরাঙ্গীরচর থেকে বিভিন্ন রুটে অবাধে চলাচল করছে নিষিদ্ধ ইজিবাইক ও কয়েকহাজার ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা।
তবে ইজিবাইক বাবদে এসআই আনিসুল দৈনিক ১১০০ টাকা চাঁদাবাজী করেন- লাইনম্যান পারভেজের এমন অভিযোগ অস্বীকার করে এসআই আনিসুল নিউজওয়ান২৪.কমকে বলেন, "এসব সম্পূর্ণ মিথ্যা। পারভেজ অতিরিক্ত কথাবার্তা বলেছে। আমাদের এভাবে কেউ টাকা-পয়সা দেয় না।"
অনুসন্ধানে জানা গেছে, পুরান ঢাকার লালবাগের নবাবগঞ্জ সেকশন বেড়িবাঁধ ঢাল টু নিউমার্কেট রুটে ১১০টি, সেকশন বেড়িবাঁধ টু মোহাম্মদপুরে ১২৬টি, সেকশন বেড়িবাঁধ টু কামরাঙ্গীরচরের আলীনগরে ১৩০টি, সেকশন বেড়িবাঁধ টু কামরাঙ্গীরচরের খোলামোড়া ঘাটে ৮৬টি, রসুলপুর ব্রিজ সংলগ্ন গরিবের বাজার টু ঝাউলাহাটি চৌরাস্তায় ৯৬টি, খোলামোড়া ঘাট টু মুসলিমবাগ ঠোঁটায় ৯৮টি, আলীনগর চৌরাস্তা টু লালবাগের আজিমপুর মাতৃসদন হাসপাতাল মোড়ে ১০৫টি, কামরাঙ্গীরচর টু লালবাগের কেল্লারমোড়ে ১২৮টি, কামরাঙ্গীরচরের মাদবরবাজার টু কেল্লারমোড় বেড়িবাঁধ রুটে ৫৬টি- সর্বমোট ৮শ৩০টি ব্যাটারি চালিত ইজিবাইক প্রতিদিন চলাচল করছে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, অনুমোদনহীন এসব ইজিবাইক ও অটোরিকশা চলাচলের ক্ষেত্রে শ্রেণিভেদে প্রতি ইজিবাইক থেকে লাইন চার্জসহ বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে গড়ে প্রায় ৬শ টাকা হারে চাঁদা আদায় করা হচ্ছে। খোদ পুরান ঢাকার লালবাগ ও কামরাঙ্গীরচরে চলাচলরত ৮শ ৩০টি ইজিবাইক থেকে গড়ে প্রতিদিন সাড়ে ৪ লক্ষাধিক টাকা চাঁদা আদায় করা হচ্ছে।
এই চাঁদার বড় একটি অংশ হাত বদল করে সংশ্লিষ্ট থানার হাবিলদার-এসআই হয়ে ওসির টেবিলে পৌঁছে যাচ্ছে। চাঁদার বাকি অংশ সংশ্লিষ্ট এলাকার ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও শাসক দলের নেতাকর্মীরা ভাগ-বাটোয়ারা করে নিচ্ছে।
ফলে সরকারিভাবে নিষিদ্ধ চার্জার ব্যাটারিচালিত এসব ইজিবাইক সরকারি দলের নামধারী এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অর্থলিপ্সু কিছু ব্যক্তির কারণে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
এদিকে, ব্যাটারিচালিত ইঞ্জিনরিক্সার মিস্ত্রি আব্দুল জব্বার জানান, এসব রিক্সার গতি সাধারণ রিক্সার তুলনায় অনেক বেশি। তবে দ্রুত চলাচলে এসব রিক্সা যান্ত্রিক হওয়া সত্বেও সে অনুপাতে গতি নিয়ন্ত্রকের কোনো ব্যবস্থা নেই। ফলে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা বেশি। এসব রিক্সা চালাতে পরিশ্রম কম বলে অনেক চালকই পছন্দ করছেন।
নিষিদ্ধ এসব যানের অবাধ চলাচল সম্পর্কে জানতে চেয়ে যোগাযোগ করা হলে বিআরটিএ চেয়ারম্যান আইয়ুবুর রহমান নিউজওয়ান২৪.কমকে জানান, এসব যানবাহনের গুণগতমান ও নিরাপত্তা স্ট্যান্ডার্ড রেজিস্ট্রেশন উপযুক্ত নয়। তাই কোনোভাবেই এসব যানবাহনের অনুমোদন দেওয়া বা রেজিস্ট্রশন করা সম্ভব নয়।
গত ৫ মে সাভারে মহাসড়ক পরিদর্শনকালে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের নিষিদ্ধ ব্যাটারিচালিত ইজিবাইক ও অটোরিক্সা (ইঞ্জিনরিক্সা) চলাচল বন্ধে দ্রুততম সময়ের মধ্যে দেশব্যাপী সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করতে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষকে (বিআরটিএ) নির্দেশ দিয়েছেন। তবে মন্ত্রীর এ নির্দেশ আজো বাস্তবায়ন হয়নি।
কিন্তু উচ্চ আদালত ও মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ মানছেন না বিভিন্ন এলাকার খোদ শাসক দলের নেতাকর্মী ও নিষিদ্ধ এসব যানের মালিক-চালকেরা।
এ ব্যাপারে মুঠোফোনে লালবাগ থানায় যোগাযোগ করা হলে ওসি মনিরুজ্জামান বলেন, ইজিবাইক চলাচল সম্পর্কে এভাবে তথ্য দেওয়া যাবে না, দরকার হলে থানায় এসে সরাসরি জেনে নিন।
কামরাঙ্গীরচর থানার ওসি শেখ মুহসীন আলম বলেন, থানা পুলিশের চেয়ে ট্রাফিক পুলিশ এ বিষয়ে ভালো তথ্য দিতে পারবে, সুতরাং ট্রাফিক বিভাগে যোগাযোগ করুন।
এরপর ডিএমপি’র দক্ষিণ ট্রাফিক বিভাগে যোগাযোগ করা হলে লালবাগ জোনের ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (টিআই) সাইফুল ইসলাম বলেন, সরকারিভাবে নিষিদ্ধ এসব যান চলাচল বন্ধে নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। মাঝেমধ্যেই অভিযান চালানো হচ্ছে। ইতোমধ্যেই কয়েকটি ইঞ্জিনরিক্সা ও ইজিবাইক আটক করে ডাম্পিংয়ে পাঠানো হয়েছে।
এ অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে জানান তিনি।
তবে এসব বিষয়ে জানতে ডিএমপি’র ট্রাফিক দক্ষিণ-পশ্চিম বিভাগের ডিসি’র সঙ্গে যোগাযোগ করে তার কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে ডিএমপি’র লালবাগ বিভাগের এডিসি (ভারপ্রাপ্ত ডিসি) মারুফ বলেন, “উচ্চ আদালত ও মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ মেনেই লালবাগ বিভাগে এসব যান চলাচল বন্ধে মাঝেমধ্যেই অভিযান চালানো হচ্ছে।”
তবে প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে কিছু কিছু রুটে নিষিদ্ধ এসব যান চলাচল করার বিষয়টি তিনি জানেন না দাবি করে বলেন, অতি দ্রুততম সময়ের মধ্যেই নিষিদ্ধ এসব যানবাহন নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
নিউজওয়ান২৪.কম/একে