আইয়ুব বাচ্চু ‘ফ্যাক্ট’
‘কী পেলাম, কী হারালাম’
তানভীর আহম্মেদ সরকার
নিউজ ওয়ান২ ৪
প্রকাশিত : ১০:০০ পিএম, ১৯ অক্টোবর ২০১৮ শুক্রবার
ব্যান্ড সঙ্গীতের গিটার জাদুকর, সঙ্গিতাঙ্গনের কিংবদন্তি শিল্পী আইয়ুব বাচ্চু
ব্যান্ড সঙ্গীতের গিটার জাদুকর, সঙ্গিতাঙ্গনের কিংবদন্তি শিল্পী আইয়ুব বাচ্চু। বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে নেয়ার আগে মারা যান তিনি। তার বয়স হয়েছিল ৫৬ বছর।
এদিকে, মৃত্যু প্রসঙ্গে তার পরিবারের স্বজনরা জানান, বৃহস্পতিবার সকালে ধানমণ্ডির বাসায় হৃদপিণ্ডের কার্যকারিতা বন্ধ হয়ে গেলে তাকে দ্রুত হাসাপাতালে নেয়া হয়। ওই সময় রাস্তায় নেয়ার পথে আইয়ুব বাচ্চুর মৃত্যু হয়।
সকাল সাড়ে ৯টার দিকে এই শিল্পীকে রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে নেয়া হলে সকাল ৯টা ৫৫ মিনিটে কর্তব্যরত চিকিৎসক বাচ্চুকে মৃত ঘোষণা করেন।
ক্যারিয়ার জীবনে আইয়ুব বাচ্চু নিজেকে পরিচয় দিতে ভালোবাসতেন একজন গিটারিস্ট হিসেবে। তারপর বলতেন তিনি একজন গায়ক। তাছাড়া আইয়ুব বাচ্চু নিজেই গান লিখতেন, সুর করতেন।
এদিকে, আইয়ুব বাচ্চুর অকাল প্রয়াণে স্তব্ধ সঙ্গিতাঙ্গন। বেশ হতাশায় ভুগছেন এই অঙ্গনের শিল্পীরা। তবে এমনটা হওয়ার কারণ কী? বাংলাদেশের সঙ্গীতে জগতে তিনি কতটা প্রভাব রেখেছেন?
চলুন জেনে নেয়া যাক: আমরা কী পেলাম
এ বিষয়ে শিল্পী ও সঙ্গীত পরিচালক ফেরদৌস ওয়াহিদ বলেন, আইয়ুব বাচ্চু তার নিজের স্থান থেকে বাংলাদেশের সঙ্গীত জগৎকে শতভাগ দিয়ে গেছেন। তিনি বলেন, প্রথমত তিনি একজন গিটারিস্ট, টিউনার এবং গায়ক। এসব বিষয়গুলো যদি ধরি তাহলে ১০০% তিনি দিয়ে গেছেন। বেঁচে থাকলে ওভার হয়ে যেতো।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের অধ্যাপক লীনা তাপসী বলেন, আইয়ুব বাচ্চু তার প্রচেষ্টা দিয়ে বাংলাদেশের ব্যান্ড মিউজিক জগতের পথিকৃৎ হয়ে ছিলেন। তার ধ্যানজ্ঞান, চিন্তা এবং কঠোর সাধনা দিয়ে তিনি এই জায়গায় উন্নীত হয়েছেন। এটা অর্জন করা কিন্তু একদিনের বিষয় না। এক কথায় বলতে চাই, তিনি যে ধারাটা তৈরি করে গেছেন সেটা অপূরণীয়, ইর্ষনীয়।
লীনা তাপসী আরো বলেন, তাকে যারা ভালোবাসেন, তারা এখন বাচ্চুর মতো করে গান গাইবে, গিটার বাজাবে।
এদিকে, আইয়ুব বাচ্চুর ইন্ডাস্ট্রিকে কী দিয়েছেন এমন প্রসঙ্গে মিউজিক কোম্পানি ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনস অব বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক এস. কে. শাহেদ আলী বলেন, তার বেশির ভাগ অ্যালবাম ব্যবসার দিক থেকে সফল। ফলে তিনি ইন্ডাস্ট্রির জন্য অনন্য ভূমিকা পালন করে গেছেন।
তিনি আরো বলেন, একসময় ঈদ আসার পূর্বে ভক্ত-দর্শকরা অপেক্ষা করে থাকত, কখন বাচ্চুর অ্যালবাম রিলিজ হবে? ওই সময় তাদের কাছ থেকে প্রচুর ফোনও আসত। তাছাড়া বিভিন্ন মফস্বল কেন্দ্রিক এলাকায় অ্যালবাম দিতে দেরি হলে তারা অনেক রাগ, অভিমান করত।
আইয়ুব বাচ্চু মূলত ব্যান্ডের গান ছাড়াও লোকসঙ্গীত, আধুনিক গান এবং বাংলা সিনেমার গান গেয়েছেন।
আইয়ুব বাচ্চু ১৯৬২ সালে চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। গানের জগতে আসেন ব্যান্ড ফিলিংসের মাধ্যমে। এর আগে বন্ধুদের সঙ্গে ছোটখাটো অনুষ্ঠান করতেন। কিন্তু ১৯৭৮ সাল থেকে ফিলিংসের সঙ্গে তিন বছর তিনি চট্টগ্রামের বিভিন্ন হোটেলে ইংরেজি গান করেছেন।
মূলত বাচ্চুর সঙ্গীতজগতে যাত্রা শুরু হয় ফিলিংস ব্যান্ডের সঙ্গে ১৯৭৮ সালে। তার কন্ঠ দেয়া প্রথম গান ‘হারানো বিকেলের গল্প’। এটির কথা লিখেছিলেন শহীদ মাহমুদ জঙ্গী।
তাছাড়া ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সালে তিনি সোলস ব্যান্ডের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত ‘রক্তগোলাপ’ আইয়ুব বাচ্চুর প্রথম প্রকাশিত একক অ্যালবাম। এই অ্যালবামটি তেমন একটা সাফল্য পায়নি।
আইয়ুব বাচ্চুর সফলতার শুরু তার দ্বিতীয় একক অ্যালবাম ‘ময়না এর মাধ্যমে’। ১৯৯১ সালে বাচ্চু ‘এলআরবি’ ব্যান্ড গঠন করেন। এই ব্যান্ডের প্রথম অ্যালবাম প্রকাশিত হয় ১৯৯২ সালে। এটি বাংলাদেশের প্রথম দ্বৈত অ্যালবাম।
এই অ্যালবামের ‘শেষ চিঠি কেমন এমন চিঠি’, ‘ঘুম ভাঙ্গা শহরে’, ‘হকার’ গানগুলো জনপ্রিয়তা লাভ করে। পরে ১৯৯৩ ও ১৯৯৪ সালে তার দ্বিতীয় ও তৃতীয় ব্যান্ড অ্যালবাম সুখ ও তবুও বের হয়। সুখ অ্যালবামের ‘সুখ’, ‘চলো বদলে যাই’, ‘রূপালি গিটার’, ‘গতকাল রাতে’ উল্লেখযোগ্য গান।
আইয়ুব বাচ্চুর অকাল প্রয়াণে আমরা কী হারালাম:
সোলস’র সদস্য পার্থ বড়ুয়া বলেন, কিছু বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। তিনি আমার শিক্ষক ছিলেন। আমাকে তৈরি করেছেন। গিটার শিখিয়েছিলেন। গান করতে ঢাকায় নিয়ে এসেছিলেন। মূলত তিনিই আমার গানের গুরু ছিলেন।
কখনোই ভাবিনি বাচ্চু ভাই এভাবে হঠাৎ করে চলে যাবেন। উনার মতো গিটারিস্ট এই উপমহাদেশে আর আছে কি না আমার জানা নেই। সংগীতাঙ্গন বড় সম্পদ হারালো। বেশ কষ্ট হচ্ছে এটা মেনে নিতে। বাচ্চু ভাইয়ের মতো শিল্পী আর বাংলাদেশে আসবে কি না, তাতেও সন্দেহ আছে।
সঙ্গীতশিল্পী শুভ্রদেব বলেন, আইয়ুব বাচ্চুর মতো এমন গায়ক ও কম্পোজার একশ’ বছরে বাংলাদেশ পাবে কি না সংশয়। তার মতো গিটার বাজাতে এশিয়ার অনেকেই জানেন না। তার কম্পোজ ছিল দুর্দান্ত। সব থেকে বড় গুন ছিল, সবার সঙ্গে আন্তরিক ব্যবহার করতেন আইয়ুব বাচ্চু।
সঙ্গীতশিল্পী ফেরদৌস ওয়াহিদ বলেন, বাচ্চুর সঙ্গে আমার পরিচয় আশির দশকে। গানের কারণেই আমার আর ওর গভীরতা। সারাটি জীবন সে ছিল গানের পাগল, গিটারের পাগল। ওর গানগুলো যেমন ভালো, তার চেয়েও ভালো ছিল ওর মন। ওকে এভাবে হারাবো চিন্তাতীত। বাচ্চুদের জন্ম বারবার হয় না। ওর শূন্যতা কাটানো সম্ভব না।
নিউজওয়ান২৪/এএস