নিষিদ্ধ ‘সংখ্যা’
নিউজ ডেস্ক
নিউজ ওয়ান২ ৪
প্রকাশিত : ০৫:২৩ পিএম, ১৮ অক্টোবর ২০১৮ বৃহস্পতিবার
ফাইল ছবি
অসির চেয়ে মসি বড়- বহুল প্রচলিত একটি প্রবাদ এটি। বাস্তবেও কি তাই নয়? অবশ্যই তাই, ইতিহাস বারবার সাক্ষ্য দিয়ে যায় এর পক্ষে। ধর্মের কথাই ধরা যাক, পবিত্র ধর্মগ্রন্থগুলোর ঐশী বাণীর জোরেই হাজার হাজার বছর ধরে ধর্মগুলো পৃথিবীর মানুষের পথ নির্দেশনা হয়ে টিকে আছে। শুধু অস্ত্রের জোরে যদি ধর্ম টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করা হতো, সবকিছু কত আগে ভেসে যেত তার কোনো ইয়ত্তা নেই!
লেখক দার্শনিকদের কলম চিরকাল অপশক্তির বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে এসেছে, তাদের মনে ত্রাস সৃষ্টি করে এসেছে। তাই যুগে যুগে নিপীড়কদের ছোবল থেকে রেহাই পায়নি বইগুলোও, বহু বই নিষিদ্ধ হয়েছে, পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। হলিউডের 'দ্য বুক থিফ' সিনেমায় রয়েছে এর জ্বলজ্বলে উদাহরণ। তবে শুধু যে বই ই নিষিদ্ধ হয়েছে এমনটি নয়, ইতিহাস ঘাটলে পাওয়া যায়, নিষিদ্ধ হতে হয়েছে অনেক নাম্বার বা সংখ্যাকেও! নিষিদ্ধ সেসব সংখ্যার ইতিহাস কি ছিলো?
প্রাচীন পূর্বপুরুষরা হিসেব রাখতেন টালি চিহ্ন ব্যবহার করে। গাছের পাতায় দাগ কেটে সে সব চিহ্ন বসানো হতো। কিন্তু কৃষি বিপ্লবের পর এবং মানুষ যখন বড় গোত্র গঠন করে বসবাস শুরু করলো তখন ফসলের হিসাব ও বিশাল গোত্রের জনসংখ্যার হিসাব এভাবে আর রাখা সম্ভব হল না। মোটামুটি খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে প্রাচীন গ্রিসে সংখ্যার ধারণা ভালোভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। গণিতবিদ পিথাগোরাস ও তার শিষ্যরা বিভিন্ন জ্যামিতিক আকৃতি, সংগীতের সুর ও আকাশের তারকারাজির সংখ্যাগত প্যাটার্ন তৈরি করেন। তারা বিশ্বাস করতেন মহাজগতের পবিত্রতম ও গহীনতম সত্যগুলো লুকিয়ে আছে সংখ্যার মাঝে।
এদিকে হিপোসাস নামক পিথাগোরাসের এক শিষ্য বিরক্তিকর কিছু একটা আবিষ্কার করে বসলেন। তিনি দেখলেন কিছু কিছু পরিমাণকে কোনো মতেই পূর্ণ সংখ্যা অথবা ভগ্নাংশ দিয়ে প্রকাশ করা যায় না। যেমন, এক একক বাহুবিশিষ্ট কোনো বর্গক্ষেত্রের কর্ণের দৈর্ঘ্য। এই ধরনের সংখ্যাকে বর্তমানে অমূলদ সংখ্যা বলে। হিপোসাসের এ আবিষ্কারকে ভালোভাবে নিলেন না পিথাগোরাস ও পিথাগোরাসের অনুচররা। তাদের ছন্দবদ্ধ সংখ্যাগত প্যাটার্নে এটি যেন ছিল একটি আঘাত, পিথাগোরাস যে নিখুঁত ছন্দময় সমীকরণের পৃথিবী কল্পনা করতেন হিপোসাসের আবিষ্কার তাতে জল ঢেলে দেয়।
ঐতিহাসিকদের মতে, হিপোসাসকে এই আবিষ্কার জনসমক্ষে প্রচারের অভিযোগে শাস্তিস্বরূপ বনবাসে পাঠানো হয়। তবে পৌরাণিক কাহিনী অনুযায়ী, দেবতারা তাকে পানিতে ডুবিয়ে মৃত্যুদণ্ড দেন। অমূলদ সংখ্যার আবিষ্কার প্রাচীন যুগের দার্শনিকদের যে গভীর চিন্তায় ফেলে দেয় তা তো জানা গেলো। কিন্তু পরবর্তী কালে কিছু কিছু গাণিতিক আবিষ্কার কিন্তু রাজনীতিবিদ ও ধর্মীয় নেতাদেরও কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে!
এখন যে আবিষ্কারটির কথা বলব, সেটি মধ্যযুগের। ইউরোপে তখনো রোমান সংখ্যার ব্যবহার চলছে। মিশরীয়সহ অন্যরা ইতোমধ্যেই আবিষ্কার করে ফেলেছে পজিশনাল নাম্বার পদ্ধতি (বাইনারি, ডেসিমাল, হেক্সাডেসিমাল ইত্যাদি) যেখানে শূন্যও অন্তর্ভুক্ত ছিল। যখন আরবের বণিকরা ব্যবসার উদ্দেশ্যে ইতালির বিভিন্ন বন্দরে প্রথমবারের মতো পাড়ি জমান, সেখানকার নাবিক ও ব্যাংকাররা নতুন এ সংখ্যা পদ্ধতির সঙ্গে পরিচিত হয়ে বেশ চমৎকৃত হলেন। তারা বুঝতে পারলেন আরবদের এ সংখ্যা পদ্ধতি বেশ সহজ ও স্বল্প সময়সাপেক্ষ।
তখনকার ইউরোপের প্রশাসকরা ছিলেন অনেক বেশি সতর্ক। তারা দেখলেন এ ইন্দো আরবীয় সংখ্যাগুলো সহজেই আকৃতি বদল করে অন্য সংখ্যা নির্দেশ করতে পারে। ঠিক যেমন ইংরেজি নাইন নাম্বারটিকে উল্টে দিলে সিক্স হয়। বণিকদের কাছে সংখ্যাগুলো আপাতত পরিচিত হলেও সাধারণ ক্রেতাদের কাছে সেগুলো তখনো দুর্বোধ্য। অন্যদিকে, সংখ্যা হিসেবে শূন্যের আবিষ্কার ঋণাত্মক সংখ্যার দ্বার খুলে দিল, ঋণের হিসাব রাখাও সহজ হলো। মহাজনদের থেকে নেয়া ধারের হিসাব সঠিকভাবে রাখার সম্ভাবনা দেখা দিল। ফলে কারো প্রতারিত হওয়ার সুযোগও থাকলো না।
এতে সমাজের শোষকদের অসুবিধাই হল বলা যায়। তাই ত্রয়োদশ শতাব্দীতে সর্বপ্রথম ফ্লোরেন্সে ইন্দো আরবীয় সংখ্যা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। কিন্তু চাইলেই কি আর এ সংখ্যা পদ্ধতির সুবিধা অবজ্ঞা করা যায়! তাই শূন্য এবং ঋণাত্মক সংখ্যার পক্ষে-বিপক্ষের মানুষদের মধ্যে বিরোধ লেগেই থাকলো বহুদিন। ১৯ শতকে এসে ঋণাত্মক সংখ্যার ধারণা উদ্ভট আখ্যা পায়। তখনকার সময়েই জিরোলামো কারদানোর মত অনেক জগত বিখ্যাত গণিতবিদ শূন্যের ব্যবহার পরিত্যাগ করেন। এতে যদিও ত্রিঘাত ও চতুর্ঘাত সমীকরণের সমাধান পাওয়া সহজ হয়।
এমনকি আজকের পৃথিবীতেও অবস্থাভেদে অনেক সংখ্যা ব্যবহার নিষিদ্ধ। এদের মধ্যে কিছু কিছু সংখ্যা ইঙ্গিতবহ। যেমন বিভিন্ন দেশের সরকার ওই দেশের মত বিরোধী কোনো আন্দোলন বা আচার-অনুষ্ঠানের তারিখ যুক্ত সংখ্যার প্রদর্শনকে নিষিদ্ধ করে থাকে। কিছু সংখ্যার মধ্যে লুকানো থাকে তথ্য, সেজন্যও সেগুলো নিষিদ্ধ হয়। সবাই জানি আজকালকার যে কোনো ডিজিটাল ফাইল অনেকগুলো বাইনারি নাম্বারে এনকোড করা থাকে। তার মানে কোনো ডেটা নিষিদ্ধ হওয়া হল ওই ডেটার সঙ্গে এনক্রিপ্টেড নাম্বারটিও নিষিদ্ধ হওয়া।
সরকারের কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র গোপন নাম্বার দিয়ে চিহ্নিত করা হয়, সেগুলো প্রকাশ করাও কিন্তু নিষিদ্ধ। ২০০১ সালে ডিভিডি থেকে ভিডিও ডিক্রিপ্ট করার জন্য বড় বড় প্রাইম নাম্বার ব্যবহারের প্রচলন শুরু হয়। এসবও কিন্তু গোপন নাম্বার। যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে শুধু লিখিত ভাষা নয়, সংখ্যাও মানুষের ভাব প্রকাশের মাধ্যম হয়ে উঠছে। তাই বইয়ের মতো সংখ্যাও নিষিদ্ধ হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
নিউজওয়ান২৪/জেডএস