তিনি কী শিল্পী নাকি চোর?
নিউজ ডেস্ক
নিউজ ওয়ান২ ৪
প্রকাশিত : ০২:১৫ পিএম, ৫ অক্টোবর ২০১৮ শুক্রবার
ফাইল ছবি
গল্পটা এক চোরের। নাকি শিল্পীর? চুরি করা পাপ হতেই পারে কিন্তু ফ্র্যাঙ্ক অ্যাবাগনেইল জুনিয়ার এর মত চোর যদি হয় তাহলে মন্ত্রমুগ্ধের মত সেটা দেখে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই আসলে। মানুষটার জীবন এতটাই বর্ণিল যে তাকে নিয়ে তৈরি ছবিটা পর্যন্ত পায় অস্কার নমিনেশন। হ্যা, লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও আর টম হ্যাংকস অভিনীত সেই অসাধারণ ছবি 'ক্যাচ মি ইফ ইউ ক্যান' এর সেই ফ্র্যাংক-ই আমাদের এই চোর।
কি করতেন তিনি? আসলে বলা উচিৎ কি করেননি তিনি? জোচ্চুরি, ব্যাংক জালিয়াতি, ছদ্মবেশে জালিয়াতি, ব্যাংক চেক জাল করা... মোটামুটি তার লিস্টে কিছুরই কমতি নেই। এসবই তিনি করেছেন তার ১৫ থেকে ২১ বছরের মধ্যে।
ফ্র্যাংক এর শৈশব যে খুব সুখের ছিল তা নয়। ১২ বছর বয়সেই তার ফরাসী মা পওলেটের সঙ্গে বাবার সেপারেশন শুরু, ১৬ হতে না হতেই ডিভোর্স। অবশ্য তার আগেই ফ্র্যাংক চুরিবিদ্যার ঝলক দেখাতে শুরু করেছন। মজার ব্যাপার হলো প্রথম ভিকটিম ছিলেন বাবা নিজেই। তিনি ছেলেকে খণ্ডকালীন চাকরির সুবিধার জন্য নিজের গ্যাসোলিন ক্রেডিট কার্ড আর টো-ট্রাক টি দেন। ফ্র্যাংক সেই ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি করে টাকা উঠিয়ে নেন তার বান্ধবীর সঙ্গে ডেটের জন্য। যার জন্য বাবাকে দিতে হয় প্রায় সাড়ে তিন হাজার ডলার।
ব্যাংক জালিয়াতির প্রথম দিকে সে বিভিন্ন ব্যাংকে বিভিন নামে একাউন্ট খুলে টাকা ধার করে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই চম্পট দিতেন। ধীরে ধীরে তার কাজ হয়ে ওঠে আরো পরিপক্ব। নিজেই প্রায় পারফেক্ট ব্যাংক চেকের কপি তৈরি, চুম্বকের মাধ্যমে সমস্ত ব্ল্যাংক ডিপোজিট চেকে নিজের একাউন্ট নাম্বার বসিয়ে দেওয়া যেন ব্যাংকের গ্রাহকরা টাকা জমা করতে আসলে ব্ল্যাংক ডিপোজিট চেকগুলোর মাধ্যমে সব টাকা তার একাউন্টে যায়। ১৫ বছর বয়সেই ১৭ হাজার জাল চেক তৈরি করে ২৫ লাখ ডলার হাতিয়ে নেন।
একবার খেয়াল করলেন, কিছু এয়ারলাইন্স কোম্পানি তাদের দৈনিক আয় একটা ব্যাগে করে এয়ারপোর্ট এ রাখা কোম্পানির ড্রপ বক্সে ফেলতো। ফ্র্যাংক একটা সিকিউরিটি গার্ডের পোশাক জোগাড় করে ড্রপ বক্সের পাশে দাঁড়িয়ে গেলেন বক্সের উপর একটি নোটিশ লিখে, "আউট অফ সার্ভিস, ডিউটিতে থাকা সিকিউরিটি গার্ড কে দিন"... অনেক বছর পর একটি লেকচারে তিনি বলেন, তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি এই আইডিয়াটা কাজ করতে পারে, মানে একটা ড্রপবক্স কিভাবে আউট অফ অর্ডার হয়!
ছদ্মবেশী হিসেবেও তিনি ছিলেন অনন্য। শুধু যে ছদ্মবেশ নিতেন তা না, তার ম্যাজিকটা ছিল ওই পরিচয়ে চাকরিও করতেন। একবার তিনি প্যান আমেরিকান এয়ারওয়েজ এর অফিসে তাদের বিশ্বাস করাতে সক্ষম হন,তিনি পাইলট, তার ইউনিফর্ম হোটেলের ক্লিনিংয়ে হারিয়ে গেছে। তিনি একটা জাল আইডি আর পাইলট'স পাসপোর্টও তৈরি করেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এভাবে তিনি তার ১৬ থেকে ১৮ এই দুই বছরে ১৬ লক্ষ কিলোমিটারের বেশি ফ্লাই করেন, প্রায় ২৫০ টি ফ্লাইটে তিনি ২৬ টি দেশে ভ্রমণ করেন। এয়ারলাইন্স কোম্পানির পাইলট হওয়ায় হোটেল ভাড়া, খাবার থেকে শুরু করে সবকিছুই ছিল ফ্রি, কারন বিল লেখা হত এয়ারলাইন্স কোম্পানির নামে। তবে এই দীর্ঘ সময়ে তিনি কখনওই প্লেন চালনা করেননি, একবার অনুরোধে কন্ট্রোল নিতে বাধ্য হলেও তিনি সেটা অটোপাইলটে দিয়ে দেন।
কোনো রকম প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রী ছাড়াই তিনি ব্রিংহাম ইয়ং ইউনিভার্সিটিতে সমাজবিজ্ঞানের সহকারী শিক্ষক হিসেবে এক সেমিস্টার ছিলেন। এগারো মাসের জন্য তিনি প্রধান শিশু বিশেষজ্ঞের কাজ করেন জর্জিয়া হসপিটালে। নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করলেন শিক্ষানবিশ চিকিৎসকদের সুপারভাইজার হিসেবে, তার জন্য এটা তেমন কোনো সমস্যাই ছিল না কারন সুপারভাইজার হিসেবে তার কোনো মেডিকেল ডিউটিই করতে হতো না, সব ইন্টার্নরাই করতো। তবে একবার অক্সিজেন স্বল্পতায় এক শিশু মরণাপন্ন হয়ে যাওয়ায় প্রায় ধরা পড়েই যাচ্ছিলেন। তিনি এ ব্যাপারে বলতে গিয়ে বলেন 'নার্স চিৎকার করছিল "ব্লু বেইবি!!" আমার ধারণাও ছিলনা জিনিসটা কি!'
তার বয়স যখন উনিশ,তিনি হার্ভার্ড ইউনিভারসিটি ল ট্রান্সক্রিপ্ট জাল করেন,লুসিয়ানা বার এক্সাম তিনবারের বার পাস করে লুসিয়ানা স্টেট অ্যাটর্নি জেনারেল এর অফিসে চাকরি নেন!
তিনবার জেল খাটেন তিনি, দুবার পালান পুলিশ কাস্টডি থেকে। একবার আটলান্টা ফেডারেল ডিটেনশন সেন্টার থেকে ছদ্মবেশে পালান, মজার ব্যাপার হলো তারা ভেবেছিল ফ্র্যাংক একজন ছদ্মবেশী জেল ইন্সপেক্টর, যার কারনে যতদিন তিনি সেখানে ছিলেন, তাকে অন্য কয়েদিদের থেকে অনেকটাই আলাদাভাবে রাখা হতো, ভালো খাবার, ভালো থাকার জায়গাসহ আরো অনেক সুবিধাসহ।
শেষমেশ যখন তিনি ছাড়া পেলেন, কম চেষ্টা করেননি তিনি স্বাভাবিক কিছু করতে, রাঁধুনি, মুদি দোকানি সব পাথর-ই উল্টে দেখেছেন তিনি, কোনোটিতেই সুবিধা করতে পারেননি। শেষে এক ব্যাংকে গিয়ে সে নিজের ব্যাংক জালিয়াতির ইতিহাস বলেন এবং তাদেরকে অফার করেন যে তিনি ব্যাংকের কর্মচারীদের জালিয়াতি ধরার কায়দা শেখাবন। এভাবেই ধীরে ধীরে তিনি নিজের জায়গা খুঁজে পান। সারাজীবন যা করে এসেছেন, এখন তার বিরুদ্ধেই কাজ করে জীবিকা অর্জন শুরু করলেন।
আজকে ৭০ বছর বয়সে তিনি এবাগনেল এন্ড এসোসিয়েটস নামে বিরাট এক আর্থিক জালিয়াতি রোধের কোম্পানির মালিক, এফবিআই-এর লেকচারার এবং সিকিউরিটি কনসালটেন্ট! জোকারের লাইনটা যেন ফ্র্যাংক এর জন্যই, 'If you are good at something, never do it for free'.
নিউজওয়ান২৪/জেডএস