অসুস্থ সংগীতাঙ্গন, ‘রুগ্ন’ কতিপয় শিল্পী!
জিহাদ
নিউজ ওয়ান২ ৪
প্রকাশিত : ১০:৪৯ এএম, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ শনিবার | আপডেট: ১২:৫০ পিএম, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ শনিবার
ফাইল ছবি
বছর তিনেক আগেও বাংলা সংগীতাঙ্গন ছিল গানে গানে মুখর ও সমৃদ্ধ। কিছু কালজয়ী গান ছিল, যা কখনো ভোলা যায় না; কারণ গানগুলো মনে গেঁথে ছিল আজীবনের জন্য। ওই সময় ছিল মানুষের মুখে মুখে ফেরা গানের গায়ক-গায়িকা, গীতিকবি ও সুরকার।
সেসব মানুষের গাওয়া, লেখা ও সুর করা গানগুলো আজো শুনলে মনে ঠিক আগের মতোই দাগ কেটে যায়। এখন সংগীতাঙ্গনের সেই জৌলুস আর নেই। এই অঙ্গনের আজ রং বদলেছে, পরিবর্তন এসেছে শ্রোতা আর দর্শকদের রুচির। এখন ইউটিউবে শিল্পী ও প্রযোজনা সংস্থা নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেলে বুস্টিংয়ে থাকছেন ব্যতিব্যস্ত। আসলে এমনই কি সংগীতাঙ্গন চেয়েছে সবাই?
মূলত সংগীতাঙ্গন এখন অনেকটা অসুস্থ। ভাইরালে আক্রান্ত কতিপয় শিল্পী! এই যে ক’দিন আগের ঘটনা, ‘ভাইয়া, আমার আর কিছু চাই না। আমাকে একটা ভাইরাল গান করে দিতে হবে’- এমনই আবদার নিয়ে একজন নবাগত শিল্পী হাজির হয়েছিলেন এক সংগীত পরিচালকের স্টুডিওতে। তিনি এমন আবদার শুনে শুধু হতবাকই নন হয়েছেন মর্মাহত।
কিন্তু অবাক করার মতো হলেও সত্যি যে এমন ‘ভাইরাল’এ আক্রান্ত এখন সংগীতাঙ্গন। একটি বিষয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে পড়তে যখন মাত্রা ছাড়িয়ে যায় তখনই সেটাকে ভাইরাল বলা হয়। এটা যেমন গানের ক্ষেত্রে হতে পারে তেমনি হতে পারে কোনো ব্যক্তি বিশেষে বা অন্যান্য ক্ষেত্রেও। হতে পারে কোন ইতিবাচক বিষয় আবার নেতিবাচকও। তবে ‘ভাইরাল’ শব্দটি কোনোভাবেই শৈল্পিকতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।
সাম্প্রতিক সময়ে ফেসবুক ও ইউটিউবের কল্যাণে সংগীতাঙ্গন পৌছে গেছে ‘ভাইরাল’-এর উচ্চ শেখরে। কিন্তু বোদ্ধারা এটিকে সংগীতাঙ্গনের জন্য ‘বিষফোঁড়া’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। ভাইরাল বিষয়টি আমাদের দেশে ভালোভাবে পরিচিতি পেয়েছে দু’বছরের মতো হবে। তবে এই সময়ে এসে এটি বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে গেছে।
বিশেষ করে আরমান আলিফের ‘অপরাধী’ গানটি ভাইরাল হতে হতে ষোল কোটি ভিউ ছাড়িয়ে গেছে ইউটিউবে। বিষয়টিকে ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখেছেন প্রথম অনেকেই। কিন্তু অনেকেই তখন প্রশ্ন তুলেছিলেন এর মান নিয়েও। আরমান আলিফের গানটি ভাইরাল হওয়ার পর তিনি যেন ভাইরাল হওয়ার নেশায় মেতেছিলেন।
এরপর একের পর এক প্রকাশ করেন ‘নেশা’, ‘বেঈমান’, ‘কার বুকেতে থাকো’ গানগুলো। কোম্পানির চাপে এবং এই শিল্পীর ইচ্ছেয় এ গানগুলোর সুর ‘অপরাধী’র সুরের একদমই কাছাকাছি ধরনের। যা ভাইরাল করবার জন্য কোম্পানিগুলোও এসব গানের প্রচারও করছে দেদার।
এদিকে সাম্প্রতিক সময়ে মাহতিম সাকিব ও টুম্পা খানের কভার করা (একজনের গাওয়া কোন গান যখন অন্যজন গান) গানও ভাইরাল হয় ফেসবুকে। যার ফলে এ দু’জনও উঠে আসেন আলোচনায়। তাদের কদরও হঠাৎ বেড়ে যায় অডিও কোম্পানিগুলোর কাছে। সেদিক থেকে মূলধারার শিল্পীদের পাশ কাটিয়ে আরমান, মাহতিম, টুম্পা খানদের মত অনেক শিল্পী এখন বুঁদ হয়ে আছে ভাইরালের প্রত্যাশায়। তারা জানেন ভাইরাল হলে ভিউ বাড়বে উচ্চ গতিতে। আর সেটা হলেই ইউটিউব থেকে আয়টাও বেড়ে যাবে দ্রুত।
কিন্তু বোদ্ধারা এই ধরণের প্রতিযোগিতাকে (ভাইরাল) অসুস্থ আখ্যা দিয়ে আসছেন বরাংবার। তারা মনে করেন, এই ধরণের প্রতিযোগিতায় ভালো মানের গানগুলো চাপা পড়ে যাচ্ছে। ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে মূলধারার শিল্পীরা, যারা অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে এই পর্যন্ত এসেছেন।
এই প্রসঙ্গে জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী আসিফ আকবর বলেন, ভাইরাল বিষয়টিতে আমি বিশ্বাসী না। এমনকি ভিউর প্রতিযোগিতারও বিপক্ষে ছিলাম সবসময়। ভালো গান হলে মানুষ এমনিতেই শুনবে। তবে এটা ঠিক যে ভাইরালের পেছনে ছুটছেন ‘ভাইরাল রোগে আক্রান্ত’ কতিপয় শিল্পীরা। এটা হওয়া উচিত নয়। গান করার আগেই যদি ভাইরাল হওয়ার প্রত্যাশা থাকে তবে সেটা গান হবে না, হবে পণ্য। তাই এখান থেকে বেরিয়ে আসার জন্য অনুরোধ করবো সকলকে।
এই প্রসঙ্গে এমআইবি সভাপতি ও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান লেজারভিশনের চেয়ারম্যান এ কে এম আরিফুর রহমান বলেন, আমরা হুজুগে বাঙালি। এটা বার বার প্রমাণ করেছি। তবে আমি যেহেতু এই জগতের মানুষ তাই অবশ্যই ভালো গানকে প্রমোট করার দায়িত্বে থাকবো। সেদিক থেকে ‘ভাইরাল’ বিষয়টির বিপক্ষে আমি। আমি চাই ভালো মানের গান প্রমোট করতে। ভালো শিল্পীদের সংগীতাঙ্গনে পরিচয় করাতে। এটাই প্রত্যেক সংগীত সংশ্লিষ্টের উদ্দেশ্য হওয়া উচিত।
চলতি প্রজন্মের শিল্পী কাজী শুভ মনে করেন, ভাইরাল হলেই ভিউ বাড়ে। আর তা দিয়ে যদি একজন শিল্পীকে মূল্যায়ন করা হয় তবে সেটা সবার জন্য দুঃখজনক। কারণ, অনেক কষ্ট করে একজন শিল্পী নিজের জায়গা তৈরি করেন। শুধুমাত্র ভিউ দিয়ে তার মূল্যায়ন সম্ভব নয়। কিন্তু তারপরেও আমরা ‘ভাইরাল’ রোগে আক্রান্ত।
‘ভাইরাল’ প্রসঙ্গে সংগীত পরিচালক সজীব দাশ বলেন, আগে ‘হিট’ গানের আবদার করতে শুনেছি অনেক শিল্পীকে। তখন খুব বিরক্ত লাগতো। আর এখন শুনি ‘ভাইরাল’ গান করে দেয়ার আবদার। বিষয়টি আমাকে অবাক করে। এটা যে একজন সংগীত পরিচালকের জন্য কত বড় কষ্টের বিষয় সেটা বলে বোঝানো যাবে না। খুব শিগগির ‘ভাইরাল’ বিষয়টি থেকে বের না হতে পারলে সংগীতাঙ্গন আরো হুমকির মুখে পড়বে।
নিউজওয়ান২৪/জেডএস