মিজানুরকে হত্যার পর সুমাইয়াকে গণধর্ষণ
নিউজ ওয়ান টুয়েন্টি ফোর ডেস্ক
নিউজওয়ান২৪.কম
প্রকাশিত : ১০:৩৩ এএম, ২৮ অক্টোবর ২০১৭ শনিবার
ফাইল ছবি
পুলিশের তদন্ত ঘটনাটি ছিল, প্রেমিকাকে হত্যা করে প্রেমিক আত্মহত্যা করেছে। এই ঘটনায় দায়ের করা মামলাটি তদন্ত শেষে পুলিশ চুড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। পরে ঘটনাটি পুলিশ ব্যুরো ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) তদন্ত করে চাঞ্চল্যকর তথ্য পায়। এই ঘটনাটি হলো গত বছরের ২২ এপ্রিল রাজশাহীর হোটেল নাইস ইন্টারন্যাশনালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী প্রেমিক যুগলের (তরুণ-তরুণী) লাশ উদ্ধারের ঘটনা।
পিবিআই জানিয়েছে, প্রতিশোধ নিতে চার বন্ধু রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মিজানুর রহমানকে হত্যার পর তার প্রেমিকা পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সুমাইয়া নাসরিনকে ধর্ষণের পর হত্যা করে পালিয়ে যায়। চাঞ্চল্যকর এ জোড়া খুনের ঘটনায় জড়িত চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
গ্রেফতারকৃতরা হলেন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র রাহাত মাহমুদ (২১), রাজশাহী কলেজের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ছাত্র বোরহান কবীর ওরফে উত্স (২২), একই বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র আল-আমিন (২০) ও বিশ্ববিদ্যালয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে ভর্তি প্রার্থী আহসান হাবিব ওরফে রনি (২০)। আহসান ও বোরহান ইতিমধ্যে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।
পুলিশ ও আদালত সূত্রে জানা গেছে, জবানবন্দি প্রদানকারী যুবক আহসান হাবিব ওরফে রনি পাবনার ফরিদপুর থানার জন্তিহার গ্রামের এনামুল হকের ছেলে। সে রাজশাহী বরেন্দ্র কলেজ থেকে এইচএসসি পাস। হত্যাকান্ডের সময় তিনি রাজশাহীতেই অবস্থান করছিলেন। রাহাতের বাড়ি সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায়, আল আমিনের বাড়ি রাজশাহীর পবায় আর বোরহানের বাড়ি লালপুরের নাটোরে। পিবিআই কর্মকর্তারা ১৮ অক্টোবর আহসান হাবিবকে ঢাকার মিরপুর এলাকা থেকে গ্রেফতার করেন। তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পরদিন রাজশাহীর দুটি ছাত্রাবাস থেকে বাকি তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়।
পিবিআইয়ের তদন্ত কর্মকর্তারা বলছেন, সুমাইয়ার সঙ্গে রাহাতের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। সেই সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পর মিজানের সঙ্গে সম্পর্ক হয় তার। বিষয়টি জানতে পেরে ক্ষুব্ধ হন রাহাত। এরপরই পরিকল্পিতভাবে হোটেল কক্ষে গিয়ে দুজনকে হত্যা করা হয়। সবশেষে পুরো ঘটনাটিকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার জন্য মিজানের লাশটি ওড়না দিয়ে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়।
গত বছর ২২ এপ্রিল রাজশাহীর গণকপাড়ায় অবস্থিত হোটেল নাইস ইন্টারন্যাশনালের ৩০৩ নং কক্ষ থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় মিজানুর রহমান এবং বিছানায় মুখ থেলানো অবস্থায় সুমাইয়া নাসরিনের লাশ উদ্ধার করা হয়। মিজানুরের মরদেহ সুমাইয়া নাসরিনের ওড়না দিয়ে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলানো ছিল। আর সুমাইয়ার মরদেহ বিছানায় উপুড় করে রাখা ছিল।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, গত ২০ অক্টোবর রাজশাহী মেট্টোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জাহিদুল ইসলাম গ্রেফতার আহসান হাবিব রনির জবানবন্দি রেকর্ড করেন। জবানবন্দিতে রনি বলেছেন, রাহাত মাহমুদের সঙ্গে প্রথম থেকে সুমাইয়ার প্রেমের সম্পর্ক ছিল। পরে মিজানুর রহমানের সঙ্গে নতুন করে তার প্রেমের সম্পর্ক হয়। এ নিয়ে রাহাত প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য পরিকল্পনা করেন। এদিকে রাহাতের সঙ্গে রনির পূর্ব থেকে পরিচয় ছিল। রাহাত নগরীর বিনোদপুরের একটি ছাত্রাবাসে থাকতেন। সেখানে তিনি রনিকে ডেকে নিয়ে তার পরিকল্পনার কথা বলেন। মিজানুরের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কের কথা শুনে রনি বলেন, মিজানুরকে তিনি চেনেন। মিজানুরের এক পা ছোট (ল্যাংড়া)।
স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে আহসান হাবিব রনি বলেছেন, হত্যাকাণ্ডের দুই থেকে তিন দিন আগে তিনি রাজশাহী নগরীর বিনোদপুরের বায়তুল আমান ছাত্রাবাসে যান। রাহাত তখন ওখানে থাকতেন। সেখানে আসামি আল আমিন ও বোরহান কবীরও ছিলেন। চারজন মিলে তাস খেলেন। খেলার এক ফাঁকে রাহাত জানান, সুমাইয়া তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েরই আরেক ছাত্র মিজানুর রহমানের সঙ্গে প্রেম করে। রনি তখন রাহাতকে জানান যে মিজান তার পূর্বপরিচিত। রাহাত তখন দুজনকে হাতেনাতে ধরার জন্য উপস্থিত বাকি তিনজনের সাহায্য চান।
হত্যাকাণ্ডের আগের দিন রনিকে ফোন দেন মিজান। তার ভাই ও ভাবি রাজশাহী আসছেন এবং তাদের থাকার জন্য ভালো আবাসিক হোটেলের সন্ধান চান তিনি। কিন্তু রনি জানতে পারেন ভাই-ভাবি নয়, সুমাইয়া রাজশাহী আসছেন। এরপর বিষয়টি তিনি রাহাতকে জানান। রাহাত তাকে ফোন করে বলেন তিনি মিজান ও সুমাইয়াকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দেখেছেন। রাহাত তাকে বিনোদপুর যেতে বলেন। সেখানে গেলে রাহাত, আল আমিন ও বোরহানের সঙ্গে তার দেখা হয়। রাহাত একটু দূরে সুমাইয়া ও মিজানকে দেখিয়ে তাদের অনুসরণ করতে বলেন। মিজান ও সুমাইয়া একটি অটোতে ওঠেন। আরেকটি অটোতে করে চারজন তাদের অনুসরণ করেন। সুমাইয়া ও মিজান গণকপাড়া মোড়ে নাইস হোটেলের সামনে থামেন। এরপর তারা বুঝতে পারেন যে তারা ওই হোটেলে উঠেছেন।
পিবিআইয়ের তদন্ত কর্মকর্তা এসআই মহিদুল ইসলাম জানান, রাহাত ও রনি মিলে নাইস হোটেলের এক বয়কে হাত করেন। এরপর তারা চারজন নাইস হোটেলের পাশের তিন তলা একটি মার্কেটের ছাদে ওঠেন। সেখান থেকে হোটেল বয়ের সাহায্যে জানালা দিয়ে ৩০৩ নম্বর কক্ষে ঢোকেন। কক্ষে তখন শুধু সুমাইয়া ছিলেন। সুমাইয়ার সঙ্গে রাহাত ও রনির বাগ্?বিতণ্ডা হয়। মিজানকে ফোন করে ডেকে আনার জন্য সুমাইয়াকে বলেন। সুমাইয়ার ফোন পেয়েই মিজান কক্ষে আসেন। মিজানকে তারা বেধড়ক পেটান। একপর্যায়ে কেউ একজন হোটেলের টি টেবিল ভেঙে তার পায়া দিয়ে মিজানের মাথায় আঘাত করলে তিনি পড়ে যান। এরপর সুমাইয়ার একটি ওড়না দিয়ে তাঁর হাত বেঁধে ফেলা হয়। আরেকটি ওড়না দিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়। মিজানের লাশ কক্ষের মেঝেতে রেখেই সুমাইয়াকে পালাক্রমে ধর্ষণ করেন তারা। এরপর বালিশ চাপা দিয়ে তাকে হত্যা করেন। দুজনকে হত্যার পর তারা মিলিতভাবে মিজানের লাশ ওড়না দিয়ে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলিয়ে দেন। এরপর তারা আবার জানালা দিয়েই পাশের মার্কেটের ছাদ হয়ে বেরিয়ে যান। ঘটনার পর কাউকে কিছু না বলতে রাহাত রনিকে পাঁচ হাজার টাকা আর আল আমিনকে দশ হাজার টাকা দেন।
ওই তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, হত্যাকাণ্ডের পর ঘটনাস্থলে যাওয়া প্রথম পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে তিনিও একজন ছিলেন। ওই কক্ষে তিন ‘ব্র্যান্ডের’ সিগারেটের ফিল্টার পাওয়া যায়। তা ছাড়া ছেলেটার লাশ ফ্যানের সঙ্গে ঝোলানো থাকলেও তার দুই হাত ওড়না দিয়ে বাঁধা ছিল। তার প্যান্টটি কোমর থেকে ভাঁজের মতো করে নিচে নামানো ছিল। দেখেই মনে হচ্ছিল কেউ একজন টান দিয়ে নামিয়েছে। তাছাড়া মিজানের গলার দুই পাশে দাগ ছিল। আত্মহত্যা করলে সেই দাগ একদিকে হওয়ার কথা। কক্ষে পাওয়া তিন ধরনের সিগারেটের ফিল্টার তাকে সবচেয়ে বেশি ভাবায়। একজন মানুষ একই সঙ্গে তিন ধরনের সিগারেট খেতে পারে না। পুলিশ আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার পর তাতে সন্তুষ্ট না হয়ে আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে মামলার ভার পিবিআইকে দিলে তিনি তদন্ত করা শুরু করেন।
গতকাল এই প্রতিবেদকে তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেন, এই ঘটনায় গ্রেফতার চার জনের মধ্যে দুই জন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। এই ঘটনায় আরো কয়েকজন জড়িত থাকতে পারেন। ওই সব ঘটনা তদন্ত করে মামলাটির চার্জশিট দেওয়া হবে।
সুমাইয়ার বাবা পুলিশের এসআই আবদুল করিম গাইবান্ধা বি সার্কেলে কর্মরত রয়েছেন। তিনি বলেন, মেয়ে মারা যাওয়ার পর পর তিনি শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন। সেই অবস্থায় তিনি মামলার যে এজাহার লিখেছিলেন সেখানেই হত্যাকাণ্ডের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছিলেন। এরপর তদন্তের দায়িত্ব পুলিশের। তদন্ত করে তারা যা পেয়েছে তাই বলেছে।
মিজানের বাবা উমেদ আলী বলেন, মিজান আত্মহত্যা করতে পারেন না এটা তার বিশ্বাস ছিল। সেটাই প্রমাণিত হয়েছে।