ব্রিটেন সরকারের কড়াকড়িতে দিশাহারা বাংলাদেশি ছাত্ররা
নিউজ ওয়ান টুয়েন্টি ফোর ডেস্ক
নিউজওয়ান২৪.কম
প্রকাশিত : ০৮:১৮ এএম, ২৭ অক্টোবর ২০১৭ শুক্রবার
ফাইল ছবি
এক সময় ব্রিটেনে পড়তে আসা ছাত্রদের বাংলাদেশে দেখা হত অন্য চোখে। বিলেত পাস করাদের কদর ছিল চাকরি থেকে বিয়ে সর্বত্র।
তবে ২০০৯ সালে ব্রিটিশ সরকারের মানি ম্যাকিং স্টুডেন্ট স্কিম টায়ার ফোর সে ধারণা পাল্টে দেয়। কোনো ইংলিশ টেস্ট নেই, ন্যূনতম এসএসসি পাস আর ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা ব্যাংক স্টেটমেন্ট দেখাতে পারলেই ভিসা নিশ্চিত এমন এক অপূর্ব সুযোগ পেয়ে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশের ছাত্ররা ঝাঁপিয়ে পড়ে ব্রিটেনে! কিন্তু হোম অফিসের নানা নিয়মের ফেরে পড়ে এখন বাংলাদেশি ছাত্ররা দিশাহারা।
২০০৮ সালে ব্রিটেন যে অর্থনৈতিক মন্দায় পড়ে সেখান থেকে ওঠার জন্য এমন এক স্কিম হাতে নেয় সরকার। এক বছরে তারা শুধু ওভারসিজ স্টুডেন্টদের কাছ থেকে ৮ বিলিয়ন পাউন্ড সংগ্রহ করে। ২০০৯ সালের এপ্রিল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত টায়ার ফোর স্কিমে লক্ষাধিক বাংলাদেশি স্টুডেন্ট এসেছিলেন। তখন সিস্টেমের ফাঁকে যেমন মেধাবী ছাত্ররা এসেছেন, না বুঝে তেমনি অনেক সেভেন-এইট পাস লোকও এসেছেন সার্টিফিকেট ও ব্যাংক স্টেটমেন্ট জাল করে। এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে ব্রিটেনের বিভিন্ন শহরে বাংলাদেশি মালিকানাধীন শতাধিক কলেজ গড়ে ওঠে। অনেকেই কোটি কোটি টাকার মালিক হোন চোখের পলকে। শুধু বাংলাদেশি কমিউনিটিতে তখন ৩০০ মিলিয়ন পাউন্ডের লেনদেন হয় এই টায়ার ফোর স্টুডেন্টদের নিয়ে শিক্ষাবাণিজ্যে।
২০০৯ সালে টায়ার ফোর স্কিমে ব্রিটেনে আসা ছাত্র সাইম রহমান বলেন, সরকারি চাকরি ছেড়ে এসেছিলাম সোনার হরিণের আশায়। এখন অবৈধ হয়ে পালিয়ে কাজ করি। না বুঝে নিজের ভবিষ্যৎ নিজেই নষ্ট করলাম। একই সময়ে এমসি কলেজের অর্থনীতি অনার্স ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র আরিফ হোসেন চলে আসেন ব্রিটেনে। আজ তিনিও অবৈধ। আরিফ বলেন, এক মাস পরেই অনার্স ফাইনাল ছিল। সেটা না দিয়ে চলে এলাম ব্রিটেনে। এখন অবৈধ হয়ে আছি। দেশে গিয়ে তো জীবনের নষ্ট করা আট বছর ফেরত পাব না।
যখনই ব্রিটিশ সরকার অর্থনৈতিক মন্দা থেকে উঠে দাঁড়ায় তখনই এমন সব নিয়ম আরোপ করে যে টায়ার ফোর স্কিমে আসা ৮৫ শতাংশ অবৈধ হয়ে পড়ে। এদের বড় একটি অংশ চলে যায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে, একটি অংশ এখনো ব্রিটেনে অবৈধ হিসেবে রয়ে গেছে। কিছু অংশ ফিরে গেছে বাংলাদেশে। ২০১৪ সালে ব্রিটিশ হোম অফিস টোয়েক নামে একটি ইংরেজি ভাষা কোর্সকে অবৈধ ঘোষণা করলে ৪৮ হাজার স্টুডেন্টের ভিসা বাতিল করে। ব্রিটিশ সরকার বিদেশি ছাত্রদের ক্ষেত্রে যে কড়াকড়ি আরোপ করেছে তাতে মেধাবী এবং সত্যিকারের ছাত্ররা সবেচেয়ে বেশি কষ্ট করছেন। পরিস্থিতির শিকার হয়ে তারা আজকে চোখে অন্ধকার দেখছেন।
বাংলাদেশের নামকরা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স শেষ করে মাস্টার্স করতে এসেছিলেন মারুফ আহমেদ। কিন্তু হোম অফিসের নানা মারপ্যাঁচে পড়ে জীবন অতিষ্ঠ হয় তার। তিনি বলেন, এখন এমন অবস্থায় আছি যে, না পারছি দেশে ফেরত যেতে আবার না পারছি থাকতে। বাংলাদেশি স্টুডেন্ট কন্সালটেন্সি করা আবিদুর রহমান বলেন, বর্তমান নিয়মে একজন ছাত্র কলেজে যদি ফাউন্ডেশন কোর্সে পড়তে আসে তাহলে দিতে হয় বছরে বাংলাদেশি টাকায় ৩ লাখ ২০ হাজার থেকে ৪ লাখ। সেই সঙ্গে আইইএলটিএস ৫.৫ পয়েন্ট থাকতে হবে। ব্রিটেনে একজন স্টুডেন্টের থাকা, খাওয়া এবং ট্রাভেল বাবদ খরচ হয় বছরে প্রায় সাড়ে ৭ লাখ টাকা থেকে ৮ লাখ টাকা। আবার কলেজের আওতায় ভিসা নিয়ে এলে থাকবে না কোনো কাজের অনুমতি। মানে বছরে প্রায় ১২ থেকে ১৩ লাখ টাকার পুরোটাই নিজে বহন করতে হবে।
যেহেতু কাজের অনুমতি নেই তাই কাজ করা অবৈধ। তাই কেউ যদি নগদ বেতনে কোনো প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন এবং ধরা পড়েন তাহলে সাময়িক জেলে নিয়ে সেখান থেকে নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হবে। আবিদ জানান, কেউ যদি কোনো মধ্যম সারির ইউনিভার্সিটিতে পড়তে আসে তাহলে তাকে আইইএলটিএস ৬ থেকে ৭ পয়েন্ট তুলতে হবে। সেই সঙ্গে বছরে টিউশন ফি দিতে হবে বছরে ১০ লাখ থেকে ১২ লাখ টাকা। আর থাকা-খাওয়া বাবদ খরচ মিলিয়ে সেটা বছরে হবে প্রায় ২০ লাখ টাকা। তবে ইউনিভার্সিটিতে পড়তে এলে সপ্তাহে ২০ ঘণ্টা কাজের সুবিধা রয়েছে। সেই হিসাবে বছরে প্রায় ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা রোজগারের সম্ভাবনা রয়েছে। এরপর রয়েছে আরও হাঙ্গামা। যদি কেউ পড়ার বিষয় পরিবর্তন করে ভিসার মেয়াদ বাড়াতে চায় তাহলে সেটা আর এখন বাড়ানো যায় না। নিজ দেশে গিয়ে আবার আবেদন করতে হয়। সে ক্ষেত্রে ভিসা না দেওয়ার সম্ভাবনা থাকে অনেক।
শুধু ইউনিভার্সিটিতে পড়তে এলে ওয়ার্ক পারমিট নেওয়ার সুযোগ এখনো আছে তবে সেটাও অনেক শর্ত সাপেক্ষ। আগে ব্রিটেনে অনার্স করার পর দুই বছরের পোস্ট ওয়ার্ক পারমিট দেওয়া হতো যার মাধ্যমে দুই বছর ফুল টাইম কাজ করে টাকা জমিয়ে অনেকে মাস্টার্স করতে পারতেন। এরপর আবার ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে ব্রিটেনে স্থায়ী হওয়ার সুযোগ ছিল। বর্তমানে যে সব সিস্টেম আরোপ করেছে সেভাবে আর ব্রিটেনে স্থায়ী হওয়ার সুযোগ নেই বললেই চলে।
১০ বছর টানা বৈধ ভিসায় লেখাপড়া করার রেকর্ড থাকলে ব্রিটেনে স্থায়ী হওয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে সেটারও পরিবর্তন করার কথা ভাবছে সরকার। আলকট আইনি সহায়তা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত আইনজীবী সলিসিটর মিজানুর রহমান শিপু বলেন, কোনো এক সময় আমাদের ফার্মে প্রতি মাসে ১৫০-১৮০টি স্টুডেন্ট রিলেটেড কেস পরিচালনা করতে হতো। বর্তমানেও ১৫ থেকে ২০টি কেস আসে শুধু বাংলাদেশ থেকে আসা স্টুডেন্টদের। হোম অফিসের নানা নিয়মের ফেরে পড়ে বাংলাদেশি ছাত্ররা দিশাহারা। বাংলাদেশ থেকে শুধু যাদের টাকা আছে এবং লেখাপড়া শেষ করে ফেরত যাবেন তাদের জন্যই পড়াশোনার রাস্তা খোলা রয়েছে। তিনি পরামর্শ দেন ব্রিটেনে পড়তে আসার আগে যাচাই-বাছাই করেই যেন আসে সবাই।