NewsOne24

ইয়াবা পাচার বাড়ছে

নিউজ ওয়ান টুয়েন্টি ফোর ডেস্ক

নিউজওয়ান২৪.কম

প্রকাশিত : ১০:০৮ এএম, ২৬ অক্টোবর ২০১৭ বৃহস্পতিবার

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে রোহিঙ্গা বিতাড়িত হলেও মরণ নেশা ইয়াবা পাচার বন্ধ হয়নি বরং ইয়াবার পাচার এখন বেড়েছে। মিয়ানমারের ইয়াবায় বিষাক্ত হচ্ছে বাংলাদেশ। বলা হতো শুধু রোহিঙ্গারাই ইয়াবা পাচারের সঙ্গে জড়িত। মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীসহ তাদের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীই এখন ইয়াবা পাচারে সরাসরি জড়িত।
 
দমনপীড়ন ও নির্যাতনের হাত থেকে রক্ষা ও প্রাণে বাচতে বাংলাদেশে আসা অনেক রোহিঙ্গার নগদ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে তাদের হাতে ইয়াবা দিয়ে মিয়ানমারের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলে দিচ্ছে, ‘ওপারে গিয়ে বিক্রি করে খাবি।’ অনুসন্ধানে জানা গেছে, মিয়ানমারের বাংলাদেশ সীমান্তে এবং সীমান্তবর্তী এলাকায় ৩৩টি ইয়াবা কারখানা রয়েছে। যেগুলো মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সার্বিক সহায়তায় পরিচালিত হয়ে থাকে। আর এই ইয়াবা ব্যবসায়ীদের সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে মিয়ানমার সেনাবাহিনী।
 
জানা গেছে, মিয়ানমারের মংডু, সিটওয়ে, মইং, কুখাই, নামকখাম, শান, ওয়া, মংশাত, তাশিলেক, মংপিয়াং, মংইয়াং ও পাংশাং, কুনলং, টেংইং, সেন, লুই হুপসুর, কাইয়াং, মাহাজা অ্যান্ড হুমং, কেউও, মাওকমাই, কাকাং মংটন কাশিন ও আইক্কা এলাকায় ইয়াবা কারখানা বেশি। চীন ও থাইল্যান্ড সীমান্ত লাগোয়া মিয়ানমারের শান ও ওয়া রাজ্য থেকে ইয়াবার কাচামাল ইয়াঙ্গুন হয়ে রাখাইন রাজ্যের সিটওয়ে ও মংডুতে পৌছে। এসব কারখানার মধ্যে ১০টি গড়ে উঠেছে মংডু এলাকায়ই। এখন নাফ নদী পার হয়ে নৌযানে ইয়াবার চালান টেকনাফ, কক্সবাজার হয়ে সরাসরি রাজধানীতে চলে আসে। এছাড়া সীমান্তের অরক্ষিত এলাকা দিয়ে ইয়াবাসহ অস্ত্রের চালান আসছে। এই ইয়াবার চালান রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিনা বাধায় চলে যাচ্ছে।

আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর এক শ্রেণির কর্মকর্তা ইয়াবা পাচারের সঙ্গে জড়িত। স্থানীয় এক শ্রেণির রাজনৈতিক নেতাও ইয়াবা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করছেন। এমনকি অনেক ইউপি সদস্যও এই ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েছেন। কুতুপালং ক্যাম্পে বসবাসরত রোহিঙ্গা ওমর হাকিম, লম্বফাজি ক্যাম্পের বাসিন্দা ওজি উল্লাহ, মধুরছড়া ক্যাম্পের শামসুল হকসহ ৫ জন রোহিঙ্গা ইত্তেফাকের সঙ্গে আলাপকালে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা আসার সার্বিক ঘটনাবলি তুলে ধরেন।
 
তারা বলেন, মিয়ানমারের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বাংলাদেশে ইয়াবা পাচারে সরাসরি জড়িত। তাদের টাকা লুট করে ইয়াবা তুলে দিলেও রোহিঙ্গারা তা নাফ নদীতেই ফেলে দেয়। বাংলাদেশে ইয়াবা পাচারের ক্ষেত্রে মাঝি ও জেলেদের ব্যবহার করা হয় বলে রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যে উঠে এসেছে।
 
সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে একাধিকবার ইয়াবা ব্যবসায় জড়িত গডফাদাররে নতুন নতুন তালিকা তৈরি করা হলেও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সমন্বয় অপারেশন কার্যক্রম নেই। ইতিমধ্যে ইয়াবা ব্যবসায়ের সঙ্গে যুক্ত ১২ শতাধিক মূল ব্যবসায়ীর নতুন তালিকা রয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। গডফাদাররা গ্রেফতার না হওয়ায় তালিকা এখন অনেকটাই ফাইল বন্দি হয়ে রয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় র্যাব, পুলিশ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফর, কোস্টগার্ড, বিজিবি ও গোয়েন্দা সংস্থার সমন্বয়ে ইয়াবা ব্যবসায়ী ও গডফাদারের তালিকা তৈরি করা হয়। জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা ও স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সব জায়গায় ইয়াবা পাওয়া যাচ্ছে। এতে সহজেই আসক্ত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। এতে নারী নির্যাতনসহ নৃশংসতা বাড়ছে। খুন, ছিনতাই, ডাকাতি, চুরির মতো অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন তারা।

মাদকাসক্ত সন্তান তার মা-বাবাকে হত্যা করছে, মাদকাসক্ত বাবা-মা’র হাত ধরে নিজের সন্তানকে বিক্রি করে দেওয়ার ঘটনাও এখন ঘটছে। এটা দেশের জন্য বড় বিপদ।  ১৫ থেকে ৫০ বছর বয়সী নারী-পরুষ এখন এ মাদক সেবন করছে। তবে ১৬ থেকে ৩০ বছর বয়সী ইয়াবা আসক্তদের সংখ্যাই বেশি। ভয়ঙ্কর মাদক ইয়াবার থাবায় বিপন্ন হয়ে পড়েছে বহু পরিবারের সন্তানের জীবন।
 
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরাধীরা ক্রমে সহিংস হয়ে উঠছে ইয়াবার প্রভাবেই। এ বিষয়ে এখনই পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যতে জাতি মেধাশূন্য হওয়ার আশংকা রয়েছে। সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠক শেষে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রশাসনিক কার্যক্রম বাড়ানোর পাশাপাশি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। দেশকে মাদকমুক্ত করার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর জিরো টলারেন্স নীতিকে সামনে রেখে আমাদের মন্ত্রণালয় কাজ করে যাচ্ছে। কাউকেই ছাড় দেয়া হচ্ছে না।
 
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে, মিয়ানমারের সঙ্গে আমাদের ৫৪ কিলোমিটার সীমান্তের পুরোটাই অরক্ষিত। ওই সীমান্ত দিয়ে সহজে প্রবেশ করছে ইয়াবাসহ অস্ত্রের চালান। বিজিবির নজরদারির কারণে মাঝে মধ্যে ইয়াবার চালান ধরা পড়লেও গডফাদাররা কখনো ধরা পড়ে না।
 
রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে জানা যায়, মিয়ানমার আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মাদক ব্যবসায়ীদেরকে ভালোই রেখেছে, তাদের নানাভাবে সহায়তা করছে। রাখাইন প্রদেশে একের পর এক রোহিঙ্গাদের গ্রাম ও বসতভিটা পুড়িয়ে ফেললেও ইয়াবা কারখানাগুলো পুরোদমে সচল রেখেছে মিয়ানমার। সেনাসদস্যরা পালা করে ইয়াবা কারখানা পাহারা দিচ্ছে। ২০১৫ সালে একটি তালিকায় মিয়ানমারকে ৪৫টি ইয়াবা কারখানার ব্যাপারে তথ্য দেয় বাংলাদেশ। তবে মিয়ানমারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, এসব কারখানার অস্তিত্ব খুজে পাওয়া যাচ্ছে না।
 
কক্সবাজারের এক ইয়াবা কারবারির দাবি, দুই হাজার ইয়াবাসহ গ্রেফতার হয়েছিল সে, পরে জামিনে ছাড়া পায়। তবে এখন আর ইয়াবার কারবার করছে না। পরিচয় গোপন রাখার শর্তে ওই কারবারি জানায়, মংডুর সুয়েজা ডেইলপাড়া, বাউলি বাজার, থাং ইয়, আনাইক্কা, আল লে থান কিওয়ে, সংসমা, আকিয়াব, সুয়েজা খায়নলখালী, ফয়েজপাড়া, নোয়াপাড়া, আলে কালাইওয়া, জাদিপাড়া, সাবাইগন, কিম্বুক, কাইম্রুক, তমব্রু, দাগশিন নীল ও সিটওয়ের কিছু এলাকায় প্রকাশ্যে পাইকারি দরে ইয়াবা কেনাবেচা হয়। বাংলাদেশ থেকে ডিলার গিয়ে বা সেখানকার ডিলাররা বস্তায় ভরে ইয়াবা নিয়ে আসে। ওই সব এলাকায় ইয়াবার শতাধিক ছোট কারখানা আছে। ইয়াবা তৈরির যন্ত্রগুলো ছোট ও বহনযোগ্য। ফলে কারবারিরা সহজেই বাসাবাড়িতে গোপনে কারখানা চালু করছে। মিয়ানমার সীমান্ত এলাকার কয়েকটি সূত্র জানায়, টেকনাফ এলাকায় এখন রশীদের ইয়াবার চালান বেশি আসছে। এর আগে সবচেয়ে বেশি ইয়াবা পাঠাত আলম নামের এক ডিলার।
 
কক্সবাজার জেলা পুলিশ সুপার মোঃ ইকবাল হোসেন বলেন, প্রায় প্রতিদিনই পুলিশ, র্যাব, বিজিবি, গোস্টগার্ড ইয়াবা উদ্ধার করছে, ইয়াবা পাচারে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষীসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে জড়িত রোহিঙ্গারাও গ্রেফতার হচ্ছে। কিন্তু বন্ধ হচ্ছে না ইয়াবা আসা। এ কারণে অভিযান অব্যাহত রাখা হয়েছে।
 
আমাদের টেকনাফ সংবাদদাতা জানান, টেকনাফে বিজিবি সদস্যরা অভিযান চালিয়ে ৩০ লাখ টাকা মূল্যের ইয়াবা আটক করেছে। মঙ্গলবার রাতে এই ইয়াবা চালানটি আটক করা হয়।

সূত্র: ইত্তেফাক