কোন মামলায় গ্রেফতার ‘ভ্যালেন্টাইন শফিক রেহমান’!
স্টাফ রিপোর্টার
নিউজওয়ান24.কম
প্রকাশিত : ০৩:১৯ পিএম, ১৬ এপ্রিল ২০১৬ শনিবার | আপডেট: ০১:০৬ পিএম, ২১ মে ২০১৬ শনিবার

ঢাকা: চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট কাম সাংবাদিক শফিক রেহমানকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
শনিবার সকাল ৮টার দিকে একসময়ের ভীষণ পাঠকপ্রিয় সাময়িকী যায় দিনের সাবেক সম্পাদক ও বিএনপিপন্থি এই বুদ্ধিজীবীকে নিউ ইস্কাটনের বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। প্রসঙ্গত, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার অনেক ভাষণই শফিক রেহমানের লেখা।
ঢাকা মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) মারুফ হোসেন সরদার জানান, ২০১৫ সালের আগস্টে রাজধানীর পল্টন থানায় দায়ের রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় শফিক রেহমানকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
তবে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অপর সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে ও তার তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়কে অপহরণ ও হত্যা চেষ্টা মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে শফিক রেহামনকে।
এ অবস্থায় শফিককে আসলে কোন মামলায় গ্রেফতার করা হয়েছে- এ নিয়ে শুরুতে কিছুটা ধূম্রজাল দেখা দেয়। পরে তা পরিষ্কার করা হয়। পুলিশ সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রীপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়কে ‘অপহরণের চক্রান্তে’ এফবিআইকে ঘুষ দেওয়ার দায়ে যুক্তরাষ্ট্রে বিএনপির এক নেতার ছেলের দণ্ড দেয় দেশটির আদালত। সেই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ পুলিশ যে মামলাটি করেছিল, তাতেই গ্রেফতার দেখানো হয়েছে শফিক রেহমানকে।
নিউ ইয়র্কে জয়কে অপহরণ ও হত্যাচেষ্টার ষড়যন্ত্রের দায়ে বিএনপির সহযোগী সংগঠন জাতীয়তাবাদী সাংস্কৃতিক সংস্থার (জাসাস) সহসভাপতি মোহাম্মদ উল্লাহ মামুনের ছেলে রিজভী আহমেদ সিজার বর্তমানে দণ্ডিত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে কারাভোগ করছেন। রিজভী আহমেদ সিজারের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি প্রধানমন্ত্রীর ছেলে জয় সম্পর্কে তথ্য পেতে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (এফবিআই) এক কর্মকর্তাকে ঘুষ দিয়েছেন। বাংলাদেশ পুলিশের ভাষ্য অনুযায়ী, ২০১১ সাল থেকেই সজীব ওয়াজেদ জয়কে অপহরণের চেষ্টা চলছিল। এর তদন্ত করতে গিয়েই মামুন ও সিজারের নাম উঠে আসে।
যুক্তরাষ্ট্র বিএনপির সাবেক সহসভাপতি ও জাসাস নেতা মামুন যুক্তরাষ্ট্রের কানেকটিকাটের বাসিন্দা। আর শফিক রেহমান সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বিএনপির কাউন্সিলের আন্তর্জাতিক বিষয়ক প্রস্তুতি উপকমিটির আহ্বায়ক ছিলেন। তিনি বিএনপিপন্থি থিঙ্কট্যাংক জি-নাইন এর লোক হিসেবেও পরিচিত।
যায় যায় দিন, শফিক রেহমান ও অন্যান্য প্রসঙ্গ
শফিক জগন্নাথ কলেজের (বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়) সাবেক অধ্যক্ষ প্রখ্যাত অধ্যাপক সাইদুর রহমানের ছেলে। ছাত্রদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয়, জেদি ও ঠোঁটকাটা স্বভাবের এবং স্বঘোষিত নাস্তিক এই গুণী অধ্যাপক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শিক্ষক ছিলেন। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অধ্যাপক সাইদুরের মতো পুত্র শফিকও একই মতবাদের অনুসারী।
মূল পেশায় চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট শফিক রেহমান গত শতকের ৮০ এর দশকে সাপ্তাহিক যায় যায় দিন প্রকাশনার মাধ্যমে ব্যাপক পরিচিতি পান। যায় যায় দিন সম্পাদনার মাধ্যমে প্রগতিশীল, মুক্তমনা ধারণার প্রচার ও মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের বিরোধী মতের অবস্থান শফিক রেহমানকে শিক্ষিত মহলে ব্যাপক গ্রহণযোগ্য করে তোলে। সামরিক শাসক এরশাদের রোষানলে পড়ে তাকে দেশও ছাড়তে হয়েছিল। এরশাদ পতনের পর ফের বাংলাদেশে ফেরেন বিবিসির সাবেক কর্মী শফিক।
এক দশক পরে বিশেষ করে প্রথম হাসিনা সরকার ক্ষমতায় আসার পর ডানপন্থি রাজনৈতিক শক্তির দিকে ক্রমশ ঝুঁকে পড়েন তিনি। এসময় বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠতে দেখা যায়। এর মধ্যে ‘দৈনিক যায়যায়দিন প্রতিদিন’ নামে ট্যাবলয়েড দৈনিক বের করেন তিনি। কিন্তু অল্প সময়েই তা বন্ধ হয়ে যায়। এরপর বের করেন পূর্ণ দৈনিক যায় যায় দিন। কিন্তু একপর্যায়ে এটাও চালাতে না পারার পর যায় যায় দিনের স্বত্ব বিক্রি করে দেন। এ সময়টায় নিজ প্রতিষ্ঠানের সাংবাদিকদের সঙ্গে সম্পর্কের চরম অবনতি হয় তার। একপর্যায়ে তিনি গোপনে দেশ ছাড়তে গিয়ে বিমানবন্দরে বাঁধার মুখে ফিরে আসেন।
বর্তমানে জামায়াতের পত্রিকা হিসেবে পরিচিত দৈনিক নয়া দিগন্তে কলাম লেখেন এবং নিজের সাময়িকী মৌচাকে ঢিল সম্পাদনা করেন। বিরোধী পক্ষ মনে করে শফিক রেহমান বিএনপিপন্থি একজন আন্তর্জাতিক লবিস্ট। তার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান লবিং গ্রুপের এক সময়ে সখ্যতা ছিল।
টেলিভিশনে একসময় আনন্দ মেলার উপস্থাপক হিসেবেও তাকে দেখা গেছে। বিএনপি নেত্রী খালেদার নানা কর্মসূচিতেও তাকে দেখা যায়। তার টিভি শো লাল গোলাপ এখন প্রচারিত হয় বেসরকারি চ্যানেল বাংলাভিশনে। তবে বাংলাদেশে পশ্চিমা সংস্কৃতির অনুষঙ্গ ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’ বা ভালবাসা দিবসের প্রচলন ঘটিয়ে ব্যাপকভাবে একইসঙ্গে অভিনন্দিত ও নিন্দিত হন তিনি। তবে তরুণ সমাজের অনেকের কাছে ‘ভ্যালেনন্টাইন শফিক রেহমান’ হিসেবেও পরিচিতি এ্চই গুণী সাংবাদিক ও চার্টার্ড অ্যাকউন্ট্যান্ট।
যেভাবে গ্রেফতার হলেন
শফিক রেহমানকে রাজধানীর ইস্কাটনের নিজ বাসা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়ার বর্ণনা দিয়েছেন বাসার কেয়ারটেকার (তত্ত্বাবধানকারী) আব্দুল মতিন মোল্লা।
আব্দুল মতিন মোল্লার ভাষ্য, সকাল ছয়টার দিকে বাসার মূল গেটে অপরিচিত লোকের ধাক্কা পড়ে। তিন আগন্তুক জানান তারা বেসরকারি টিবি চ্যানেল বৈশাখী থেকে এসেছেন। তারা আরও জানান ওই চ্যানেলে শফিকের অনুষ্ঠান আছে। তাই তাকে স্টুডিওতে নিয়ে যেতে এসেছেন।
তিনতলায় থাকা শফিক রেহমানকে বিষয়টি জানানো হয়। এসময় তার নির্দেশমতো আগন্তুকদের নাশতা খাওয়ানো হয়। তবে এরপর থেকে শফিক রেহমানের নামতে দেরি হচ্ছিল। ঘণ্টা দুয়েক পর আগন্তুকরা কেয়ারটেকার আব্দুল মতিন মোল্লাকে একটি ভিজিটিং কার্ড দিয়ে ওপরে শফিকের কাছে যেতে বলেন।
আব্দুল মতিন উপরে উঠতে শুরু করলে কথিত টিভি চ্যানেলের তিনজনও তার পেছনে পেছনে দোতলা পর্যন্ত উঠেন। এপর্যায়ে শফিক রেহমানকে সিঁড়িতে দেখতে পান সবাই।
আব্দুল মতিন বলেন, শফিক দোতলায় নামার পর ওই তিনজন ডিবি থেকে এসেছে বলে জানান। তারা শফিকের নিচে নিয়ে যাওয়ার সময় তার বাবুর্চি আলী বাধা দেন। এসময় শফিক তাকে বলেন, “তুই আসবি না।”