ফিজিওথেরাপি সঠিক না হলে ঘটতে পারে হিতে বিপরীত
লাইফস্টাইল ডেস্ক
নিউজওয়ান২৪
প্রকাশিত : ০৭:৪৯ পিএম, ২৯ মে ২০২৩ সোমবার
ফাইল ফটো
চিকিৎসা সেবায় ফিজিওথেরাপির গুরুত্ব অপরিসীম। বাংলাদেশে এই চিকিৎসা তৃণমূল পর্যন্ত না পৌঁছলেও বড় বড় শহরের অনেক সরকারি-বেসরকারি চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এ সেবা দেওয়া হয়। তবে এর সঠিক চিকিৎসা নিয়ে রোগীদের মধ্যে এখনো অনেক শঙ্কা রয়েছে। থেরাপির সঠিক প্রয়োগ না হলে রোগীর ক্ষেত্রে হতে পারে হিতে বিপরীত।
এখন জেনে নেয়া যাক ফিজিওথেরাপি কি এবং কেন প্রয়োজন?
ফিজিও (শারীরিক) ও থেরাপি (চিকিৎসা)- এ দুইটি শব্দ থেকে এসেছে ফিজিওথেরাপি শব্দটি। এটি একটি স্বতন্ত্র চিকিৎসাব্যবস্থা, যেখানে শারীরিক ব্যায়ামের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করা হয়। শুধু ওষুধ সব রোগের পরিপূর্ণ সুস্থতা দিতে পারে না। বিশেষ করে বিভিন্ন মেকানিক্যাল সমস্যা থেকে যে সব রোগের সৃষ্টি হয়, তার পরিপূর্ণ সুস্থতা লাভের উপায় ফিজিওথেরাপি।
ফিজিওথেরাপি আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক অন্যতম এবং অপরিহার্য শাখা। একজন ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক স্বাধীনভাবে রোগীর বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যা (প্রধানত বাত-ব্যথা, আঘাত জনিত ব্যথা, প্যারালাইসিস, সড়ক দুর্ঘটনা, শারীরিক প্রতিবন্ধিতা, বিকলাঙ্গতা, পক্ষাঘাত ও বড় কোনো অস্ত্রোপচারের পর রোগীর স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসাসহ বিভিন্ন ধরনের বাত, মাথা, ঘাড়, কাঁধ, পিঠ,কোমর ও হাঁটুর ব্যথা এবং স্পোর্টস ইনজুরিতে পরিপূর্ণ চিকিৎসা সেবা প্রদান করে থাকেন।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) এবং ওয়ার্ল্ড কনফেডারেশন ফর ফিজিক্যাল থেরাপি (ডব্লিউসিপিটি)-এর মতে স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক প্রফেশনাল ডিগ্রিধারীরাই ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক বা ফিজিওথেরাপিস্ট এবং স্বাধীনভাবে চিকিৎসা সেবা প্রদান করতে পারেন।
ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা পদ্ধতি
একজন ফিজিওথেরাপিস্ট রোগীর রোগ বর্ণনা, ফিজিক্যাল টেস্ট, ফিজিওথেরাপিউটিক স্পেশাল টেস্ট, প্রয়োজন সাপেক্ষে বিভিন্ন রেডিওলজিক্যাল টেস্ট এবং প্যাথলজিক্যাল টেস্ট এর মাধ্যমে রোগ নির্ণয় বা ডায়াগ্নোসিস করে থাকেন। অতঃপর রোগীর সমস্যা অনুযায়ী চিকিৎসার পরিকল্পনা অথবা ট্রিটমেন্ট প্লান করেন এবং সেই অনুযায়ী নিচের পদ্ধতিতে ফিজিওথেরাপি সেবা প্রদান করে থাকেন।
-ম্যানুয়াল থেরাপি
-ম্যানিপুলেটিভ থেরাপি
-মোবিলাইজেশন
-মুভমেন্ট উইথ মোবিলাইজেশন
-থেরাপিউটিক এক্সারসাইজ
-ইনফিলট্রেশন বা জয়েণ্ট ইনজেকশন
-পশ্চারাল এডুকেশন
-আরগোনমিক্যাল কনসালটেন্সি
-হাইড্রোথেরাপি
-ইলেকট্রোথেরাপি বা অত্যাধুনিক মেশিনের সাহায্যে চিকিৎসা (যেমন: TENS, IRR, Traction ইত্যাদি)। ফিজিওথেরাপি চিকিৎসাতে মেশিনের ব্যবহার খুবই নগন্য। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ড্রাগ্স বা ঔষধও ব্যবহার করতে হয়।
বাংলাদেশে ফিজিওথেরাপি
ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার গুরুত্ব অনুধাবন করে ১৯৭৩ সালে আরআইএইচডি (বর্তমানে নিটোর) ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার ওপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসা অনুষদের (এমবিবিএস ও বিডিএস একই অনুষদের অধিভুক্ত) অধীন স্নাতক ডিগ্রি চালু করা হয়। বর্তমানে নিটোর, সিআরপি, পিপলস ইউনিভার্সিটি, গণ বিশ্ববিদ্যালয়, স্টেট কলেজ অব হেলথ সায়েন্সসহ ৭টি ইনস্টিটিউটে ফিজিওথেরাপি গ্র্যাজুয়েশন কোর্স চালু রয়েছে।
কোথায় চিকিৎসা নিবেন?
বাংলাদেশে প্রতিদিন গড়ে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষ ফিজিওথেরাপি চিকিৎসার ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু এর মধ্যে শতকরা প্রায় ৯০ ভাগ সঠিক ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা পায় না এবং অপচিকিৎসার শিকার হন। আমাদের দেশে এই চিকিৎসাসেবাটি বিভিন্ন মহলের অপপ্রচার (ব্যায়াম ও স্যাক) ও অপব্যবহারের (কোয়ালিফাইড ফিজিওথেরাপিস্ট ছাড়া অন্য কোনো চিকিৎসক কর্তৃক ফিজিওথেরাপি পরামর্শ দেওয়া) কারণে সাধারণ মানুষ সঠিক চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। তাই ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা ও পরামর্শ নেয়ার জন্য অবশ্যই একজন বিশেষজ্ঞ ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে হাসপাতালে বা ক্লিনিকে ভর্তি থেকে ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা নিতে হয়। সেক্ষেত্রে রোগী দ্রুত আরোগ্য লাভ করে।
তবে আশার ব্যাপার হলো- মানুষ এখন সচেতন হচ্ছে। তাই তারা ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা ও পরামর্শ নেয়ার জন্য একজন বিশেষজ্ঞ ফিজিওথেরাপি চিকিৎসকের খোঁজ করে তার তত্ত্বাবধায়নে চিকিৎসা নিতে চান।
এ বিষয়ে স্প্রিং ফিজিওথেরাপি অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারের চিফ কনসালটেন্ট ড. আবু মোহাম্মদ মুসা বলেন, বাংলাদেশে সরকারি চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে ফিজিওথেরাপি দেওয়ার বিষয়টা সেই অর্থে নেই। দেশে স্বায়ত্তশাসিত ও প্রাইভেটলি এই চিকিৎসা দেওয়া হয়। সেক্ষেত্রে স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক প্রফেশনাল ডিগ্রিধারীরাই ফিজিওথেরাপি চিকিৎসক বা ফিজিওথেরাপিস্ট হতে পারেন। দেশে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠানে ফিজিওথেরাপিস্ট ছাড়াই এই থেরাপি দেওয়া হয়। এতে রোগীরা সঠিক সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
সঠিক ফিজিওথেরাপি প্রসঙ্গে উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ধরুন কারো হাতে ব্যথা হয়েছে। হাতের বিভিন্ন অংশ রয়েছে। সেক্ষেত্রে হাতের ঠিক কোন অংশে ব্যথা হয়েছে সেটি নির্ণয় করা। পরে সেই অংশের জন্য থেরাপি দেওয়া। অন্যথায় হাতের অন্যান্য অংশেও আক্রান্ত হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় রোগীর ঘাড়ে ব্যথা হয়েছে। এর সঠিক থেরাপি না হওয়ায় মেরুদণ্ডও আক্রান্ত হয়েছে। অভিজ্ঞ থেরাপিস্ট না হলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এমনটি ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া ঐসব প্রতিষ্ঠানগুলোর যন্ত্রগুলো নিয়েও প্রশ্ন থাকে। এটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে রোগীদের সঠিক সেবা দিতে আমরা স্প্রিং ফিজিওথেরাপি অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার চালু করেছি। এখানে সব আধুনিক যন্ত্রপাতি ও মেশিন আনা হয়েছে। এখানে রোগীরা তাদের শতভাগ সঠিক সেবা নিশ্চিত করতে পারবেন। দেশের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞ ফিজিওথেরাপিস্ট রয়েছেন। রোগীদের জন্য সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে চিকিৎসা উপযোগী মনোরম পরিবেশ রয়েছে।
আরো অনেক চিকিৎসা ব্যবস্থা থাকতে রোগীরা কেন ফিজিওথেরাপি নেবে— এমন প্রশ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহিদ বুদ্ধিজীবী ড. মোহাম্মদ মোর্তজা মেডিকেল সেন্টারের এই কনসালট্যান্ট বলেন, বেশির ভাগ চিকিৎসা ব্যবস্থা ওষুধ ব্যবহার করা হয়। অপারেশন করাতে হয়, শরীরের বিভিন্ন অংশ কাটা-ছেড়া করা লাগে। এসবের নানা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া আছে। কিন্তু সঠিক ফিজিওথেরাপির কোনো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই। অপারেশন করা লাগে না। তবে বিশেষ ক্ষেত্রে সামান্য ওষুধ প্রয়োগ লাগতে পারে। তাই ফিজিওথেরাপি চিকিৎসা ব্যবস্থায় অত্যন্ত নির্ভরতার জায়গা।
খরচ সম্পর্কে জানতে চাইলে ড. আবু মোহাম্মদ মুসা বলেন, চিকিৎসা ব্যয় নিয়ে মানুষের মধ্যে ভুল ধারণা আছে। ধরেন কোনো রোগে অপারেশন করা লাগলো। সেখানে লক্ষাধিক টাকা খরচ হয়ে যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অপারেশন আরো ব্যয়বহুল হয়ে যায়। কিন্তু ফিজিওথেরাপির ক্ষেত্রে এই খরচটা এত হয় না। হিসাব করলে তুলনামূলক অনেক কম খরচ হয়। থেরাপির ওপর নির্ভর করে ২৫০০-৩০০০ টাকা লাগে। তবে কয়েক সেশনে এই থেরাপি প্রয়োগ করতে হয়। রোগীকে থেরাপির ধরনের ওপর নির্ভর করে কখনো ১৫ দিনের সেশন দেওয়া হয়, কখনো ১০ অথবা সাতদিনের সেশনও দেওয়া হয়। তবে খেয়াল রাখতে হবে সঠিক থেরাপিটা পাচ্ছেন কিনা সেদিকে রোগীকে সচেতন থাকতে হবে। এটি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ রোগীর মাথা ব্যথা হলে পেটে ব্যথার চিকিৎসা দেওয়া হলে এটি হিতে বিপরীত ঘটবে। এর জন্য স্প্রিং ফিজিওথেরাপি অ্যান্ড রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার একটি নির্ভরতার জায়গা।
নিউজওয়ান২৪.কম/আরএডব্লিউ