সতীত্ব ও পবিত্রতা রক্ষাও আমানতদারির অংশ
নিউজ ডেস্ক

ফাইল ছবি
পবিত্র কোরআনুল কারিমে আমানত শব্দটিকে যে তিনটি শব্দে ব্যবহার করা হয়েছে এগুলোর মধ্যে এক প্রকার হলো, ‘আফত’ অর্থাৎ পবিত্রতা। যাকে উর্দু পরিভাষায় ‘আফত ওয়া পাকদামানি’ অর্থাৎ পবিত্রতা শব্দে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
কেননা মুফাসসির ইবনে জাওযিসহ অন্যান্য মুফাসসিরদের একটি ব্যাখ্য হলো, ‘আফত’ শব্দটি আমানতের তৃতীয় অর্থ। যা পবিত্র কোরআনুল কারিমে ‘আফত’ শব্দ দ্বারাই এসেছে। এর দ্বারা আমানতের অর্থ নেয়া হয়েছে। মহান আল্লাহ তায়ালার বর্ণনায় এসেছে, ‘নিশ্চয় আপনি যে গোলাম রেখেছেন সে শক্তিশালী ও আমানতদার। এ আয়াতে আমানতদার বুঝাতে ‘আমিন’ শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। এর আগপড়ের বর্ণনা শব্দটির ‘পবিত্রতা’ অর্থ আরও স্পষ্ট করবে। এই আয়াতটি হজরত মুসা (আ.) এর সঙ্গে সম্পর্কিত।
ঘটনাটির কিছু ব্যাখা:
ঘটনাটি পবিত্র কোরআনুল কারিমে বিস্তারিত বলা হয়েছে। এখানে প্রয়োজনের খাতিরে কিছু বর্ণনা করছি। হজরত মুসা (আ.) ফেরাউননের হামলা থেকে বাঁচার জন্য কেনানে চলে যান। তিনি ওই শহরের একটু দূরে বিয়াবান জঙ্গলের পাশ দিয়ে অতিক্রম করছিলেন। জঙ্গলের পাশে একটি কূপ। ওই কূপে মানুষ তাদের প্রাণীদের পানি পান করাচ্ছিল। দুটি বালক অপেক্ষা করছে, লোকেরা নিজেদের পশুদের পানি পান করা শেষে নিজেদের বকরিগুলোকে পানি পান করাবে। ওই দুটি বালক হজরত শুয়াইব (আ.) এর সন্তান ছিল।
হজরত মুসা (আ.) লক্ষ করলেন, এ দুটি দুর্বল ও নিস্পাপ ছেলে কতক্ষণ পর্যন্ত অপেক্ষা করবে? নিকটে এসে ওই দুটি ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের সমস্যা কি? তারা উত্তর দিল, আমরা ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের বকরিগুলোকে পানি পান করাতে পারব না যতক্ষণ পর্যন্ত লোকেরা তাদের পশুদের পানি পান না করে অবসর হবে। আসল কথা হলো, আমাদের এই কাজ এ জন্য করতে হচ্ছে, আমাদের সম্মানিত পিতা বৃদ্ধ।
তাদের কথা শোনার পর হজরত মুসা (আ.) তাদের বকরিগুলোকে পানি পান করিয়ে দিলেন। ছেলে দুটি আনন্দিত হয়ে ঘরে ফিরে যায়। পিতা শুয়াইব তাদের দ্রুত ফেরার কারণ জিজ্ঞেস করলেন। ছেলেরা ওই যুবকের কাহিনি শুনায় যে আজ পানি পান করিয়ে দিয়েছিল। হজরত শুয়াইবের অনুমান হলো, তিনি কোনো এক পরদেশি। তাই তিনি মনে করলেন, এই পরদেশিকে সাহায্য করবেন। সুতরাং নিজের একজন কন্যা ওই পরদেশিকে সংবাদ পৌঁছানোর জন্য পাঠিয়ে দিলেন।
হজরত মুসা (আ.) পানি পান করার পর ওই কূপের পাশেই এক গাছের নিচে বসে আরাম করছিলেন। শুয়াইবকন্যা এসে হজরত মুসা (আ.)-কে বললেন, আপনাকে আমার সম্মানিত পিতাজি দাওয়াত পৌঁছিয়েছেন। কারণ, আপনার পানি পান করানোর পুরস্কার দিতে চান। ওই অবস্থায় হজরত মুসা (আ.) এর একটু সাহায্যের প্রয়োজন ছিল। তিনি তা আল্লাহ প্রদত্ব নেয়ামত মনে করে দাওয়াত কবুল করে চলতে থাকেন।
হজরত শুয়াইব (আ.) এর সঙ্গে হজরত মুসার সাক্ষাৎ ও পরিচয় হলো। হজরত শুয়াইব (আ.) মুসার পরিচয় জানার পর বুঝতে পারলেন হজরত মুসা মহান আল্লাহ তায়ালার খাস বান্দা। মেধা ও বুদ্ধিতেও ছিল নবীদের মতো। হিরাই হিরাকে চিন্তে পারে। যে কন্যা হজরত মুসা (আ.)-কে ডাকার জন্য গিয়েছিলেন সে তার পিতা নিকট যে শব্দগুলোর দ্বারা যুবকের প্রশংসা করেছিল তা ছিল অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত ও অর্থবহ। যে কারণে হজরত শুয়াইব (আ.) খুব দ্রুত এ বুদ্ধিমান যুবককে নিজের বানিয়ে নিলেন এবং তাকে নিজের আত্মীয়ের তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করার সিদ্ধান্ত নিলেন। কন্যা তার পিতার নিকট আবেদন করল, হে আব্বাজান! এই যুবককে গোলাম হিসাহে রেখে দিন। কেননা শক্তিশালী ও আমানতদার গোলাম উত্তম। এখানে কোরআনুল কারিম মুসা (আ.) এর যে বিশেষ গুণ উল্লেখ করেছে তা হলো, শক্তিশালী ও আমানতদার। যে গোলামের মধ্যে এই গুণাবলি পাওয়া যাবে তাকেই চাকর হিসাবে রাখা উচিত। হজরত শুয়াইব (আ.)-কে যখন তার কন্যা এই পরামর্শ দিল তখন শুয়াইব (আ.) জিজ্ঞাস করলেন, তোমার তার শক্তিমত্বা ও আমানতদারি সম্পর্কে কি জানা আছে?
তার মেয়ে বলল সে কূপের ওপর থেকে এমন পাথর একাকি উঠিয়ে ফেলেছে যাকে দশজনের কম লোক উঠাতে পারবে না। তার আমানতদারি সম্পর্কে আমার জানা হলো যে, যখন আমি তাকে ডাকার জন্য যাই এবং আমি আপনার সংবাদ তাকে দিই সে তা গ্রহণ করে চলতে থাকে। আমি তার সামনে সামনে চলি যাতে করে তাকে পথ দেখাতে পারি। কিন্তু সে আমাকে বলল ‘তুমি আমার পিছনে চল। যদি আমি ভুল পথে চলি তখন তুমি কঙ্কর নিক্ষেপ করবে। যাতে আমি সঠিক পথে চলে আসতে পারি।’ (তাফসিরুল মুনির)। কিছু বর্ণনায় রয়েছে যে শুয়াইবকন্যা বলেন, যখন আমি তার নিকট পৌঁছলাম তখন দৃষ্টি অবনত করে ফেলল এবং দৃষ্টি উঠিয়ে আমার দিকে পর্যন্ত তাকায়নি।
এই পুরো ঘটনার বর্ণনায় বুঝা যায়, লজ্জাস্থান হেফাজতও আমানতদারি। যার হেফাজতরে জন্য চোখের হেফাজত অত্যাবশ্যকীয়। কেননা এই ইজ্জতসম্ভ্রম হেফাজতের জন্য হজরত মুসা (আ.) তার বিয়েতে মহরের বিনিময়ে ১০ বছর ছাগল চড়িয়ে ছিলেন। কোরআনুল কারিমে সূরা কেসাসে এর বর্ণনা পাওয়া যায়। হজরত উতবা ইবনে আল মনযির আস সালামি বলেন, ‘আমরা রাসূল (সা.) এর খেদমতে ছিলাম। তিনি তখন ত্ব সিন মিম অর্থাৎ সূরা কেসাস তেলাওয়াত করতে করতে যখন মুসা (আ.) এর ঘটনায় পৌঁছলেন ইরশাদ করেন, ‘নি:সন্দেহে হজরত মুসা (আ.) নিজের পবিত্রতা ও নিজের পেটের ক্ষুধা মিটানোর জন্য ৮/১০ বছর চাকরি করেন এবং কার চাকরি করেন? শ্বশুরালয়ের। আজ কালের স্বামীদের তো শ্বশুরালয়ের চাকরি চিন্তাও করা যায় না।’
হাদিসেও পবিত্রতা ও আত্মসংযমের গুরুত্ব কয়েক জায়াগায় বর্ণনা করা হয়েছে। যার দ্বারা বুঝা যায় পবিত্রতাও আমানতের অন্তর্ভূক্ত। এটাও ঈমানের এক অংশ। যা পূর্ণ করা একজন মুসলমানের জন্য অত্যন্ত জরুরি। কেননা জবানের হেফাজতের পাশাপাশি লজ্জাস্থানের হেফাজতের ওপর জান্নাতের ওয়াদা নবুওয়াতি জবান দ্বারা করা হয়েছে। নবী কারিম (সা.) বলেন, যে ব্যক্তি নিজের জবান ও দুই রানের মধ্যভাগের হেফাজত করবে আমি তার জন্য জান্নাতের জিম্মাদারি নিয়ে নিচ্ছি (বুখারি)।
লজ্জাস্থানের হেফাজত কতটা গুরুত্বপূর্ণ এর সামান্য ঝলক নিম্নে বর্ণিত ঘটনায় বুঝে আসবে। যে ঘটনারি বোখারি মুসলিম ব্যতীত হাদিসের অনেক কিতাবেই আলোচনা করা হয়েছে।
ঘটনার বিবরণ:
ইসলামপূর্ব সময়ে লোকদের মধ্যে তিনজন রাতের সফরে বের হয়েছিল। তারা পাহাড়ে একটি গুহায় রাত্রিযাপন করে। ঘটনাক্রমে পাহাড় থেকে একটি পাথরখন্ড তাদের গুহার মুখে এসে পড়ে। যার কারণে গুহার মুখ বন্ধ হয়ে যায়। তারা তিনজনই বলল, আমরা ততক্ষণ পর্যন্ত এ বিপদ থেকে নাজাত পাবো না যতক্ষণ পর্যন্ত না আল্লাহর নিকট নিজেদের ভালো কাজের বিনিময়ে দোয়া না করব। সুতরাং তিনজনই তাদের নেক আমলের বিনিময়ে আল্লাহর নিকট দোয়া করল।
একজন দোয়া করল, হে আল্লাহ! আমার বৃদ্ধ বাবা-মা ছিল। আমি তাদের ওপর আমার স্ত্রী সন্তান সন্ততি ও ধনসম্পদকে প্রাধান্য দেয়নি। একরাত তো এমন হলো যে, আমি কোনো একটি জিনিস খোঁজার জন্য বের হলাম। তাই সময় মতো আমি তাদের দুধ পান করাতে পারিনি। ঘরে পৌঁছে আমি তাদের জন্য দুধ দোয়াই। কিন্তু তারা ঘুমিয়ে পড়েছিল। আমি উপযুক্ত মনে করলাম না যে তাদেরকে জাগ্রত করি এবং তাদের সম্মানে নিজের সন্তানদের কাউকেও দুধ পান করাইনি। এমনকি সকাল পর্যন্ত আমি তাদের অপেক্ষা করতে থাকি। যখন সকাল হলো তারা জাগ্রত হয়ে দুধ পান করল। হে আল্লাহ! যদি আমি এই আমল শুধুমাত্র আপনার সন্তুষ্টির জন্য করে থাকি তাহলে আমাদের ওপর থেকে এই পাথরখন্ড উঠিয়ে দাও। সুতরাং পাথরখন্ডের কিছু অংশ ঘষে পড়ে। কিন্তু এটা এতটুকু ছিল না যে তারা বের হয়ে আসতে পারবে। হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, তাদের মধ্যে দ্বিতীয় জন এই দোয়া করল হে আল্লাহ! আমার এক চাচাত বোন ছিল। যে নাকি আমার খুব পছন্দের ছিল। আমি তাকে খারাপকাজের প্রস্তাব দিয়েছিলাম। কিন্তু সে আমাকে তার ওপর জয়ী হতে দেয়নি। এক সময়ে দুর্যোগ ছড়িয়ে পড়ে। সে মুখাপেক্ষী হয়ে আমার কাছে সাহায্যের জন্য আসে। আমি তাকে ১২০ দিনার এই শর্তে দিই যে, সে আমাকে তার ওপর জয়ী হতে দিবে। অপারগ হয়ে সে রাজি হয়ে যায়। যখন আমি তার ওপর শক্তিশালী হয়ে উঠলাম তখন সে আমাকে বলল হে আল্লাহর বান্দা! আল্লাহকে ভয় কর। আমি তোমার জন্য হালাল নই। এই মুহূর্তে এটা শুনে আমি খারাপ কাজ করা থেকে বিরত থাকি। যখন সে আমার মাশুক ছিল তাই তার দিনারও মাফ করে দিলাম। হে আল্লাহ! যদি আমি আমার এই কাজ তোমার সন্তুষ্টির জন্য করি তাহলে তুমি এই পাথর আমাদের ওপর থেকে সরিয়ে নাও। যাতে আমরা বের হয়ে যেতে পারি। সুতরাং দোয়ার পরে পাথর কিছুটা ঘষে পড়ল। কিন্তু এটাও এতটুকু ছিল না তারা বের হয়ে আসতে পারবে।
হুজুর (সা.) বলেন, তৃতীয় জন এই দোয়া করল যে, হে আল্লাহ! আমি অনেক শ্রমিক পারিশ্রমিকের বিনিময়ে রাখি। আমি সবাইকে তাদের পারিশ্রমিক পরিশোধ করে দিই। একজন ব্যতীত। সে আগে চলে যায়। আমি তার পরিশ্রমের টাকা ব্যবসায় বিনিয়োগ করে দিই। এমনকি তার সম্পদ বেড়ে যায়। কিছুদিন পর সেই শ্রমিক আসে। এবং সে তার পারিশ্রমিকের দাবি করে। আমি তাকে বললাম দেখো! যত উট যত গাভি যত বকরি যত গোলাম দেখতে পাচ্ছ এগুলো তোমার। সে বলল হে আল্লাহর বান্দা! তুমি ঠাট্টা কর না। আমি বললাম আমি ঠাট্টা করছি না। সুতরাং সে সবগুলো নিয়ে চলে গেল এবং আমার জন্য কিছু রাখেনি। হে আল্লাহ! যদি আমি এসব তোমার সন্তুষ্টি কামনায় করে থাকি তাহলে আমাদের পেরেশানি উঠিয়ে নাও। ফলে পাথর সরে যায় এবং তারা তিনজন আরামে বের হয়ে আসে। (বুখারি, মুসলিম-৭১২৫)।
মোটকথা পবিত্রতা; যাকে কোরআনি ভাষায় আমানত দ্বারা ব্যাখ্যা করা হয়েছে এটা একটা বিস্তারিত আলোচ্য বিষয়। যার ওপর বর্তমান সময়ে ব্যাপক আলোচনা প্রয়োজন। যাতে করে আমাদের তরুণ-তরুণী ও মুসলিম ছেলে-মেয়েরা এই আমানতের ওপর বিশেষ নজর রাখে এবং নিজের ঈমানের হেফাজত করে।
আজ তো অন্য কিছুর ওপর এতোটা খেয়ানত হয় না যতটা না নিজের ইজ্জত আব্রু ও সম্মানের ওপর খেয়ানত হয়। আল্লাহই একমাত্র সাহায্যকারী। মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তায়ালা সকল মুসলিম নর-নারীকে পবিত্রতা রক্ষার তাওফিক দান করুক। আল্লাহুম্মা আমিন।
নিউজওয়ান২৪/আরএডব্লিউ
- যে দোয়ায় গলার কাঁটা নেমে যাবে ইনশাল্লাহ!
- ফরজ নামাজের পর প্রয়োজনীয় কিছু আমল
- দরুদে ইব্রাহিম
- মা-বাবার জন্য দোয়া
- তাহিয়্যাতুল-মাসজিদ
মসজিদে ঢুকেই দু’রাকাত নামাজ... - পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সময়সূচি...
- দরুদে ইব্রাহিম
- কোরআন হাদিসের আলোকে জুমা’র দিনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
- ঋণ মুক্তির সর্বোত্তম আমল
- ফজিলতপূর্ণ কিছু দোয়া ও আমলসমূহ
- পবিত্র কোরআনের তথ্যকণিকা
- জুমার দিনের ৩ আমল
- হযরত আদম আ. এর বিয়ের মহর কত ছিল!
- ফেরেশতা পরিচিতি...
- ‘নিশ্চয় নামাজ অশ্লীল ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখে’