ঢাকা, ২১ এপ্রিল, ২০২৫
সর্বশেষ:

প্রিয় আমার পাঠশালা: বাবা বিষয়ক জটিলতা

লুৎফর রহমান রিটন

প্রকাশিত: ২০:৩৯, ২৩ অক্টোবর ২০১৬   আপডেট: ২০:৪৩, ২৩ অক্টোবর ২০১৬

ফাইল ফটো

ফাইল ফটো

আজিজুর রব স্যার ছিলেন আমার সময়ের প্রধান শিক্ষক। খুবই স্মার্ট ছিলেন তিনি। স্যুট-টাই পরে স্কুলে আসতেন। ওই পোশাকে স্যারকে মানাতোও বেশ। স্কুলের হেড মাস্টার হলেও তাঁকে মনে হতো কলেজের প্রিন্সিপাল। মোটা কালো ফ্রেমের চশমার কারণে স্যারের চেহারায় আলাদা একটা আভিজাত্য ফুটে উঠতো।

আজিজুর রব স্যার আমাকে খুবই ভালোবাসতেন। ক্লাশ নাইনে ওঠার পর শ্রেণিকক্ষে আমার উপস্থিতির হার দেখে অন্যান্য শিক্ষকরা যখন বিচলিত চিন্তিত এবং রাগান্বিত তখন আজিজুর রব স্যারই ছিলেন আমার পক্ষে দাঁড়ানো একমাত্র হাস্যোজ্জ্বল শিক্ষক। আমাকে নিয়ে অনেক উচ্চাশা ছিলো আজিজুর রব স্যারের। তাঁর মতো আরেকজন শিক্ষক ছিলেন আমার পক্ষে। তিনি মমতাজ স্যার। বেঁটেখাটো স্বাস্থ্যবান হাসিখুশি মানুষ।

আমাকে নিয়ে তাঁর উচ্চাশা ছিলো এরকম--আমাদের রিটন একদিন নজরুলের মতো কবি হবে কিংবা একদিন ইত্তেফাক সম্পাদক হবে! তখন দৈনিক ইত্তেফাক ছিলো সর্বোচ্চ সার্কুলেশন সম্বৃদ্ধ পাঠকনন্দিত পত্রিকা। ঘরে ঘরে তখন ইত্তেফাক রাখা হতো। সেই ইত্তেফকের কচি-কাঁচার আসরে আমার আঁকা ছবি ছাপা হয়। আমার লেখা ছাপা হয়। আর টিচার্স রুমে ইত্তেফাকের পাতা উলটে ওখানে আমার উপস্থিতি দেখে মমতাজ স্যার আমাকে নিয়ে তাঁর উচ্চাশার কথাগুলো বলতেন সহকর্মীদের। স্কুল ছেড়ে আসার পর মমতাজ স্যারের সঙ্গে আর দেখা হয়নি আমার।

আজিজুর রব স্যার একদিন বিস্ময়কর একটা কাণ্ড করলেন। ক্লাশে আমার অনুপস্থিতি আমার স্কুল পালানো ইত্যাদি বিষয়গুলো নালিশ আকারে তাঁর কাছে পৌঁছেছিলো। ক্লাশ শুরুর আগে, আমাদের এসেম্বলিতে একদিন আজিজুর রব স্যার খুব সুন্দর একটা বক্তৃতা করলেন শিক্ষক ও ছাত্রদের উদ্দেশে। এক পর্যায়ে স্যারদের উদ্দেশে বললেন--রিটন প্রায়ই স্কুল থেকে পালায়। ক্লাশে অনুপস্থিত থাকে। স্যারেরা তাকে নিয়ে বিরক্ত এবং চিন্তিত। স্যারদের উদ্দেশে আমার একটা আর্জি আছে। একটা দুইটা ছেলেকে এরকম হতে হয়। ক্লাশ কম করুক ক্ষতি নাই। ওকে ওর মতো চলতে দ্যান। ও ফেল করবে না। ও একদিন আমাদের সবার মুখ উজ্জ্বল করবে। ওকে একটু ছাড় দিয়েন। ওকে বেশি টাইট না দিলেন স্যার। ( আজ মধ্য-পঞ্চাশ পেরুনো পরিণত বয়েসে এসে আপনার সেদিনের সেই অবাক করা বক্তৃতার ঘটনাটা লিখতে গিয়ে আমি অশ্রুসজল হয়ে উঠছি স্যার! না ফেরার দেশে থেকেও আমি জানি আপনার স্নেহসিক্ত আশীর্বাদ আমার প্রতি বর্ষিত হচ্ছে।)

আজিজুর রব স্যারের সঙ্গে একটা মহাপ্রতারণা করেছিলাম একবার। তখন সম্ভবত নাইনে পড়ি। মজনুর রাব্বী নামে একটা গোবেচারা ছাত্র ছিলো আমাদের ক্লাশে। কচি-কাঁচার মেলার সুবাদে ওর সঙ্গে আমার পরিচয়। আমিই ওকে নবাবপুর স্কুলে ভর্তির ব্যবস্থা করে দিয়েছিলাম। ও আমাকে খুব পছন্দ করতো কিন্তু লেখাপড়ায় ছিলো বড্ড কাহিল। বিভিন্ন বিষয়ে ফেল করা ছিলো ওর অভ্যেস। সঙ্গত কারণেই ওর প্রমোশন গেলো আটকে। মজনুর রাব্বী লটকে গেলো। গরিব পরিবারের ছেলে সে। দ্রুত পড়াশুনা শেষ করে চাকরি যুগিয়ে দায়িত্ব নিতে হবে সংসারের। ছেলেটা আমাকে এসে ধরলো হেড স্যারকে বলে প্রমোশন পাইয়ে দিতে। আগা সাদেক রোডে ওদের বাড়িতে আমার যাওয়া আসা ছিলো। ওর বড় বোনেরা আমাকে খুবই স্নেহ করতো। আমাকে খুবই পছন্দ করতো ওর বাবাও। সুতরাং ভালোবাসার একটা দায়বদ্ধতাও ছিলো। মজনুর রাব্বীর প্রমোশনের জন্যে আমি হেড স্যারকে ধরলাম। আংশিক রাজি করানো গেলো তাঁকে। তিনি বললেন--ঠিক আছে আমি দেখছি। তুই ছেলেটাকে গার্জিয়ানসহ নিয়ে আয় আমার কাছে।

কিন্তু নিজের ফেল মারার সুসংবাদটি কিছুতেই গার্জেন অর্থাৎ বাবাকে অবহিত করতে চায় না মজনুর রাব্বী। ওতে তার প্রেস্টিজ বলে কিছু থাকবে না সংসারে। ছেলেটা অসহায় ভঙ্গিতে চেপে ধরলো আমাকে--কিছু একটা কর আমার জন্যে।

আমি ভাবতে থাকি, কী করা যায় ওর জন্যে। একটা নকল গার্জেন বানানোর পরিকল্পনা মাথায় নিয়ে এর-ওর কথা চিন্তা করি। শেষে মনে পড়ে সাজ্জাদ ভাইয়ের কথা। আমার বড় ভাই মিজানের বন্ধু সাজ্জাদ ভাই। একটু ফটকা আর চালবাজ টাইপের। ওয়ারিতেই থাকেন। নিয়মিত এক্সারসাইজ করেন। মিস্টার ঢাকা ধরণের মাসলম্যান সাজ্জাদ ভাই দেখা হলেই হাতের মাসল ফুলিয়ে দেখান। কথা বলেন চিটাগঙিয়া টোনে। তবে শুদ্ধ বাংলা বলতে চেষ্টা করেন। চট্টগামের লোকজন প্রমিত বাংলায় কথা বললে যেরকম হয় সাজ্জাদ ভাইয়েরও সেরকম। (মহাত্মা গান্ধিকে সাজ্জাদ ভাই বলতেন মহাত্‌মা গান্ধি!)

একদিন সাজ্জাদ ভাইকে নিয়ে মজনুর রাব্বীসহ বিসিসি রোডের হোটেল সোসাইটিতে জরুরি বৈঠকে বসলাম। বিস্তর গরম সিঙ্গারা আর চা খাইয়ে পটিয়ে ফেললাম সাজ্জাদ ভাইকে। যতোটা অসহায় নয় মজনুর রাব্বীদের পরিবার তারচে বেশি অসহায় হিশেবে ওকে পরিচয় করিয়ে দিলাম সাজ্জাদ ভাইয়ের সঙ্গে। চা সিঙ্গারার বদৌলতে নয় বরং গরিব অসহায় একটা ছেলেকে উদ্ধার করার মহান ব্রতেই রাজি হয়ে গেলেন সাজ্জাদ ভাই--ওর নকল বড় ভাইয়ের ভূমিকায় অভিনয়ে অবতীর্ণ হতে। মজনুর রাব্বী সম্পর্কে, তার পরিবার সম্পর্কে যাবতীয় খুঁটিনাটি বিষয় প্রায় মুখস্ত করিয়ে ফেললাম। কিন্তু সাজ্জাদ ভাই বারবার মজনুর রাব্বীর বাবার নামটা ভুলে যাচ্ছিলেন। আমার তো মহা টেনশন--আরে! মজনুর রাব্বীর বাবা মানে তো স্বয়ং সাজ্জাদ ভাইয়েরও বাবা! বাবার নাম ভুলে গেলে তো সমস্ত পরিকল্পনাই ভেস্তে যাবে! বাবার নামটি বিশ পঁচিশবার উচ্চারণ করিয়েও ভরসা পাচ্ছিলাম না। কারণ সাজ্জাদ ভাইকে বাবার নাম জিজ্ঞেস করলেই নিজের বাবার নাম বলে দেয়! আমি বেশ কয়েকবার হেড স্যার সেজে তাঁর রিহার্সাল ইন্টারভিউ নিলাম। আর প্রত্যেকবার তিনি বাবার নামটি ভুলে গিয়ে মজনুর রাব্বীকে জিজ্ঞেস করছিলেন--এই তোর বাবার নামটা যেনো কী রে!

বাবার নাম বিষয়ক টেনশনে হাবুডুবু খেতে খেতে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সাজ্জাদ ভাইকে জানাতে ভুলে গেলাম। আর সেটা হচ্ছে মজনুর রাব্বীরা ঢাকায় কোথায় থাকে। হেড স্যারের রুমে ওদের দুজনকে নিয়ে গেলাম। সাজ্জাদ ভাইকে পরিচয় করিয়ে দিলাম ওর বড় ভাই হিশেবে। গুরুগম্ভীর কণ্ঠে হেড স্যার কথা বলা শুরু করলেন সাজ্জাদ ভাইয়ের সঙ্গে--রিটন ছেলেটা এমন ভাবে ধরলো যে আপনার ছোট ভাইয়ের বিষয়টিকে বিশেষ বিবেচনায় ফেলতেই হলো। ওকে আমরা টিসি দেবো ঠিক করেছিলাম।

সাজ্জাদ ভাই বিনয়ে একেবারে গদগদ হয়ে জ্বি স্যার তা যা বলেছেন স্যার করে যাচ্ছেন। একটু আসি স্যার বলে আমি রুম থেকে বেরিয়ে পরলাম। আমার খুব ভয় হচ্ছিলো--এই বুঝি স্যার জিজ্ঞেস করে বসেন কোথায় যেনো বাসা আপনাদের?

যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত হয়--কথাটা যে কতো সত্যি সেটা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম কিছুক্ষণের মধ্যেই। এ-কথা স-কথা বলে হেড স্যার মজনুর রাব্বীর প্রমোশনের ব্যাপারটা প্রায় নিশ্চিত করে হঠাৎ প্রশ্ন করলেন--আচ্ছা সাজ্জাদ সাহেব আপনাদের বাসাটা যেনো কোথায় সাজ্জাদ সাহেব?

দরোজার এপাশে দেয়ালের আড়ালে দাঁড়ানো আমার নিঃশ্বাস একেবারে বন্ধ হবার যোগাড়--সব্বোনাশ! এখন কী হবে!!
সপ্রতীভ সাজ্জাদ ভাই এই প্রশ্নে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে মজনুর রাব্বীকে বললেন--বাসাটা যেনো কোথায় রে?
হেড স্যার বিস্ময়ের মহাসাগরে নিক্ষিপ্ত হলেন যেনো--আশ্চর্য! আপনি না বললেন ওর বড় ভাই! অথচ কোথায় থাকেন সেটা বলতে পারছেন না!ভেরি স্ট্রেইঞ্জ!

মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিলেন সাজ্জাদ ভাই--ইয়ে মানে হয়েছে কি স্যার, আমি চিটগং-এ থাকি তো। এরা ঢাকায় থাকে ভাড়া বাড়িতে। বুঝতেই পারছেন স্যার, খুব একটা স্বচ্ছলতা নেই। প্রায়ই বাসা বদল করতে হয়। এখন নতুন যে বাসায় আমার বাবা মা উঠেছেন(মজনুর রাব্বীর মা কিন্তু মারা গেছেন আগেই!) সেই এলাকার নামটা এই মুহূর্তে ভুলে গেছি স্যার! সরি। এই গবেট বলছিস না কেনো কোথায় থাকিস? বলে কড়া একটা ধমক লাগালেন সাজ্জাদ ভাই, মজনুর রাব্বীকে। ভীত সন্ত্রস্ত মজনুর রাব্বী অস্পষ্টভাবে উচ্চারণ করলো--আ-গা-সাদেক রোড।

আমি আর দেরি না করে দ্রুত সিঁড়ি টপকে সোজা নিচে নেমে এলাম--যদি এই মুহূর্তে স্যার সাজ্জাদ ভাইকে বাবার নাম জিজ্ঞেস করেন! কারণ এরকম বেকায়দা পরিস্থিতিতে মজনুর রাব্বীর বাবার নাম ক্যানো, সাজ্জাদ ভাই তাঁর নিজের বাবার নামটাও ভুলে যেতে পারেন! অটোয়া, ২১ অক্টোবর ২০১৬

নিউজওয়ান২৪.কম/একে

ইত্যাদি বিভাগের সর্বাধিক পঠিত