অশুভ ভাবনা ও কুসংস্কার থেকে দূরে থাকুন
নিউজ ডেস্ক

ফাইল ছবি
সফর মাস হিজরি বর্ষের দ্বিতীয় মাস। এ মাসকে কেন্দ্র করে কিছু অশুভ ভাবনা ও কুসংস্কারের প্রচলন রয়েছে। আরবরা এ মাসটিকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন মাস বলে মনে করতো। যার কোনো ভিত্তি ইসলামে নেই।
এ আলোচনা সফর মাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের বর্ণনা পবিত্র কোরআন ও হাদীসের আলোকে সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করা হলো।
সময়কে বিভিন্ন অংশে ভাগ করার রহস্য:
সময় ও কালের দীর্ঘ রশিকে নির্দিষ্ট একেকটি ভাগ ও অংশে নির্ধারণ করা যেমন- সেকেন্ড, মিনিট, ঘণ্টা. দিন-রাত, মাস-বছর ও যুগ ইত্যাদি, অনুরূপভাবে নির্দিষ্ট নামে নামকরণ, যেমন- সাপ্তাহিক বারের নাম, মাসের নাম, যুগের ভাগ ইত্যাদি, এগুলো সবই মহান রবের পক্ষ থেকে মানব জাতির জন্য এক মহা নিয়ামত। মানুষের যাবতীয় কাজ-কর্ম সুন্দর ও সুশৃংখলভাবে সম্পাদিত হওয়ার মধ্যে রয়েছে তার বড় প্রভাব। এমনটি না হলে ব্যাপারটি যে কত বড় বিদঘুটে ও উদ্বেগ সৃষ্টির কারণ হয়ে যেতো, তা ভাষায় ব্যক্ত করার কোনো অপেক্ষা রাখে না। কালের এই দীর্ঘ রশিকে বিভিন্ন ভাগ, অংশে ও নামে বিভক্তি করণ মানুষের মঙ্গলের জন্য। এতে অমঙ্গলের লেশমাত্র নেই। মানুষের সীমিত জ্ঞান দ্বারা যদি নির্দিষ্ট কোনো সময়, দিন-রাত, বার বা মাসকে অমঙ্গল ধরা হয়, তাহলে কিন্তু তা অসীম জ্ঞানের অধিকারী মহান আল্লাহর নিয়ম-নীতি ও নেযামের মধ্যেই ত্রুটি বের করার নামান্তর, যা একজন মুমিনের জন্য ধ্বংসাত্বক ভাইরাস বৈ কিছুই নয়।
কোনো দিন-ক্ষণ ও মাসকে অশুভ মনে করা:
আমাদের অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, কোনো স্থান, সময় ও মাসকে অশুভ ও অমঙ্গল মনে করা ইসলামি বিশ্বাসের চরম পরিপন্থি একটি কুসংস্কার। যার সূচনা হয় আরবের জাহিলী সমাজ থেকে। তারা ‘সফর’ মাসকে অশুভ ও বিপদ-আপদের মাস বলে বিশ্বাস করত। এটা ওই সমাজের অগণিত কুসংস্কারের অন্যতম একটি। এ মাসে কোনো শুভ কাজ যেমন- বিবাহ-শাদী, নতুন ইমারত নির্মান, দূরের কোনো সফর ইত্যাদি বিষয় থেকে বিরত থাকত।
রহমতের নবী (সা.), দিশেহারা মানবের রাহবার, সরওয়ারে কায়েনাত হজরত মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যার এ ধরাপৃষ্ঠে আগমনের অন্যতম ও প্রধান উদ্দেশ্য ছিল তাযকিয়া তথা আত্মশুদ্ধি। মহান রবের নির্দেশে তিনি মানবের বিশ্বাস ও চেতনাকে পরিশুদ্ধ-নির্মল করে নবুওয়াতের গুরু দায়িত্ব শত ভাগ পালন করেছেন। শুধু এতটুকুই করে ক্ষান্ত হননি, বরং কিয়ামত পর্যন্ত বিশ্ব মানবতার জন্য এমন দুই পরশপাথর (কোরআন ও সুন্নাহ) রেখে গেছেন, যার স্পর্শে মানবাত্মার সকল মরিচিকা দূর হয়ে সে একজন খাঁটি সোনার মানুষ বনে যেতে পারে। তিনি এই কুসংস্কারের প্রতিবাদে দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘রোগ লেগে যাওয়া, কুলক্ষণ, পেঁচা ও সফর মাসের অশুভত্বের কোনো বাস্তবতা নেই।” (বুখারী শরীফ : হা: ৫৭৫৭, ৫৭৭০, মুসলিম শরীফ : ২২২০)
এমনিভাবে আমাদের সমাজের অনেকের দ্বীন সম্পর্কে সঠিক ধারণা না থাকায় সময় ও যুগকে গালি দিয়ে বসে। অথচ হাদীসের মধ্যে দ্ব্যার্থহীন কন্ঠে ঘোষণা করা হয়েছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমরা যমানাকে গালি দিও না, কারণ আল্লাহ নিজেই হলেন যমানা।’ (মুসলিম শরীফ: হা: ২২৪৬)
হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ বলেন ‘আদম সন্তান যমানাকে গালি দেয়, অথচ আমিই হলাম যমানা, রাত-দিন আমার হাতে।’ (বুখারী শরীফ: হা: ৫৮২৭) ‘হজরত আবু হুরায়রা (রা.) রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেছেন, মহান আল্লাহ বলেন, ‘আদম সন্তান যমানাকে গালি দিয়ে আমাকে কষ্ট দেয়। অথচ আমি নিজেই যমানা, রাত-দিনকে আমি পরিবর্তন করি।’ (বুখারী শরীফ : ৭৪৯১, সুনানে আবুদাউদ : ৫২৭৪)
সফর মাসকে কেন্দ্র করে উদ্ভট কিছু বিদআত ও ভ্রান্ত আকীদা:
আরবের সেই জাহিলিয়াত সমাজের মতো আজও মুসলিম সমাজে অনেকের মধ্যে কুসংস্কার পরিলক্ষিত হয়। সফর মাসকে কেন্দ্র করে অনেক পত্র-পত্রিকা বা বই পুস্তকেও ফজীলতের নামে কুসংস্কারের প্রচার করা হয়। শুধু তাই নয়, এ সকল কুসংস্কারকে উস্কে দেওয়ার জন্য অনেক বানোয়াট কথা হাদীসের নামে বানিয়ে সমাজে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। যেমন তারা বলে, এ মাস বালা-মুসিবতের মাস। এ মাসে এত লক্ষ এত হাজার বালা-মুসিবাত নাজিল হয়। এ মাসে আদম (আ.) ফল খেয়েছিলেন। এ মাসেই হাবীল নিহত হন। এ মাসেই নূহ (আ.) এর ক্বওম ধ্বংস হয়। এ মাসে ইব্রাহিম (আ.)-কে আগুনে ফেলা হয়। এ মাসের আগমনে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ব্যথিত হতেন। এ মাস চলে গেলে খুশি হতেন। তিনি বলতেন, ‘যে ব্যক্তি আমাকে সফর মাস অতিক্রান্ত হওয়ার সুসংবাদ প্রদান করবে, আমি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করার সুসংবাদ প্রদান করবো।’ ইত্যাদি ইত্যাদি উক্তি তারা বানিয়েছে।
মুহাদ্দিসগণ একমত যে, সফর মাসের অশুভত্ব ও বালা মসীবত বিষয়ক সকল কথাই ভিত্তিহীন ও মিথ্যা এবং এ মাসে বিশেষ কোনো ইবাদতের কথাও কিন্তু মুহাদ্দিসীনে কেরাম ও ফুকাহাদের থেকে বর্ণিত নেই। অথচ তারা বানিয়েছে যে, কেউ যদি সফর মাসের ১ম রাত্রিতে মাগরিবের পরে বা এশার পরে চার রাকাত নামাজ আদায় করে, অমুক অমুক সূরা বা আয়াত এতবার পাঠ করে, তবে সে বিপদ থেকে রক্ষা পাবে, এত এত পুরস্কার পাবে। এ সবই ভিত্তিহীন ও বানোয়াট কথা বৈ কিছুই নয়।
তবে একথা ঠিক যে, কোনো কোনো মাস ও দিন অপেক্ষাকৃত অন্যান্য মাস ও দিন থেকে অধিকতর বরকতপূর্ণ, যা শরীয়তের গ্রহণযোগ্য দলীলের ভিত্তিতে সাব্যস্ত হয়েছে। কিন্তু সেখানে শুভ ও অশুভ বিষয়ে কোনো কথা বলা হয়নি। কেবল ফজিলতময় দিন ও মাস নির্ণয় করা হয়েছে। বাজারে ‘বার চাঁদের ফজীলত’সহ কিছু বই-পুস্তক পাওয়া যায়, তাতে সফর মাসের বিভিন্ন ধরনের আমলের কথা বলা আছে। যার কোনো প্রমাণ ইসলামি শরিয়তে খুঁজে পাওয়া যায় না।
আখেরি চাহার শোম্বা:
এমন একটি কথা বিভিন্ন বাজারি বই-পুস্তক ও মানুষের মুখে শোনা যায়। আর এ কথাটি ফার্সী ভাষায়, যার অর্থ ‘সফর মাসের শেষ বুধবার।’ যেহেতু সফর মাস পুরাটাই অশুভ তাই সফর মাসের শেষ বুধবার সবচেয়ে অশুভ দিন এবং এ দিনে সবচেয়ে বেশি বালা-মুসিবত নাজিল হয়। জনৈক জালিয়াতী লিখেছে, ‘সফর মাসে এক লাখ বিশ হাজার বালা-মুসিবত নাজিল হয় এবং সব দিনের চেয়ে বেশি নাজিল হয় আখেরী চাহার শোম্বাতে। সুতরাং ওই দিনে যে ব্যক্তি এই..এই.. নিয়মে চার রাকাত নামাজ আদায় করবে, আল্লাহ তায়ালা তাকে ওই বালা থেকে রক্ষা করবেন এবং পরবর্তী বছর পর্যন্ত তাকে হেফাজত রাখবেন।
তবে আমাদের দেশে বর্তমান ‘আখেরি চাহার শোম্বা’র প্রসিদ্ধি অন্য কারণে। আর তা হলো, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সফর মাসের শেষ দিকে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি সফর মাসের শেষ বুধবারে কিছুটা সুস্থ্য হন এবং গোসল করেন। এরপর তিনি পুনরায় অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং এই অসুস্থ অবস্থায় তিনি পরের মাসে ইন্তেকাল করেন। এজন্য মুসলমানরা এই দিনে তাঁর সর্বশেষ সুস্থতা ও গোসলের স্মৃতি উদযাপন করেন। অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সফর বা রবিউল আউয়াল মাসের কত তারিখ থেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং কত তারিখে ইন্তিকাল করেন, সে বিষয়ে হাদীস শরীফে কোনোরূপ উল্লেখ বা ইঙ্গিত নেই। অগণিত হাদীসে তাঁর অসুস্থতা, ওই সময়ের অবস্থা, কর্ম, উপদেশ, তাঁর ইন্তেকাল ইত্যাদির ঘটনা বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু কোথাও কোন দিন, তারিখ বা সময় বলা হয়নি। কবে তাঁর অসুস্থতা শুরু হয়, কতদিন অসুস্থ ছিলেন, কত তারিখে ইন্তেকাল করেন, সে বিষয়ে কোনো হাদীসেই কিছু উল্লেখ করা হয়নি।
অতএব, উপরের আলোচনা দ্বারা স্পষ্ট হয় যে, সফর মাসের শেষ বুধবারে বিশেষ কোনো আমলের কথা ইসলামে নেই।
এ মাসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঐতিহাসিক কিছু ঘটনা:
(ক) আল্লামা ইবনুল কাইয়ুম (রহ.) বলেন, ইসলামের সর্ব প্রথম গাযওয়া (যে যুদ্ধে রাসূল (সা.) এ মাসে নিজে অংশগ্রহণ করেছেন) ‘আবওয়া’ বা ‘ওয়াদ্দান’ দ্বিতীয় হিজরতে সফর মাসের ২য় তারিখে সংগঠিত হয়। এ যুদ্ধের পতাকা ও ঝাণ্ডা ছিল সাদা রঙ বিশিষ্ট এবং তার বাহক ছিলেন হজরত হামজা বিন আব্দুল মুত্তালিব (রা.)।
(খ) হিজরতের তৃতীয় বছর সফর মাসে ‘আদাল ও আল্ক্বারাহ’ গোত্রের বিশ্বাস ঘাতকতায় ইবনে ইসহাকের বর্ণনামতে ছয় জন এবং ইমাম বুখারী (রহ.) মতানুসারে দশ জন ক্বারী শাহাদাত বরণ করেন।
(গ) চতুর্থ হিজরির সফর মাসে বিরে মা‘ঊনার ঘটনা সংগঠিত হয়।
(ঘ) আল্লামা ইবনুল কাইয়ুমের বর্ণনা মতে খাইবার যুদ্ধে রওয়ানার সময় ছিল মুহাররমের শেষ দিকে কিন্তু বিজয় অর্জন হয় সফর মাসে। (যাদুল মা‘আদ : ৩/১৬৪, ২৪৪, ৩৩৯,৩৪০)
শেষ কথা...
মানবজাতিকে সর্বপ্রকার অন্ধকার থেকে মুক্ত করার জন্যই পবিত্র কোরআন নাজিল হয়েছে। মহান আল্লাহ তায়ালা ঘোষণা করেন, ‘এটি সেই কিতাব যা আমি তোমার প্রতি নাজিল করেছি যেন তুমি মানুষকে বের করে নিয়ে আস অনেক অন্ধকার থেকে এক আলোর দিকে।’ (সূরা: ইব্রাহিম, আয়াত: ১)।
সুতরাং মহান আল্লাহর দরবারে বিশেষ আকুতি, তিনি যেন আমাদেরকে সব ধরনের কুসংস্কার ও অন্ধকার থেকে চিরমুক্তি দান করেন। সফর মাস সম্পর্কে সকল ভ্রান্ত বিশ্বাস দূর করে দেন। আল্লাহুম্মা আমিন।
নিউজওয়ান২৪/আরএডব্লিউ
- যে দোয়ায় গলার কাঁটা নেমে যাবে ইনশাল্লাহ!
- ফরজ নামাজের পর প্রয়োজনীয় কিছু আমল
- দরুদে ইব্রাহিম
- মা-বাবার জন্য দোয়া
- তাহিয়্যাতুল-মাসজিদ
মসজিদে ঢুকেই দু’রাকাত নামাজ... - পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের সময়সূচি...
- দরুদে ইব্রাহিম
- কোরআন হাদিসের আলোকে জুমা’র দিনের গুরুত্ব ও তাৎপর্য
- ঋণ মুক্তির সর্বোত্তম আমল
- ফজিলতপূর্ণ কিছু দোয়া ও আমলসমূহ
- পবিত্র কোরআনের তথ্যকণিকা
- জুমার দিনের ৩ আমল
- হযরত আদম আ. এর বিয়ের মহর কত ছিল!
- ফেরেশতা পরিচিতি...
- ‘নিশ্চয় নামাজ অশ্লীল ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখে’