ঢাকা, ২১ নভেম্বর, ২০২৪
সর্বশেষ:

রক্তের চেয়েও লাল রঙের এক সূর্যকে দেখা গেল যেদিন

মোহাম্মদ আসাদুল্লাহ

প্রকাশিত: ২৩:৪২, ১৫ ডিসেম্বর ২০২২  

ফাইল ফটো

ফাইল ফটো

১৯৭১ সালে আমি প্রথম শ্রেণিতে পড়ি। সেই সময়ের সব ঘটনা আমার মনে নেই। তবে কিছু কিছু ঘটনা স্পষ্টভাবেই মনে আছে। 

মার্চ মাসের শুরু। ৭ই মার্চের রেসকোর্সের ময়দানে বঙ্গবন্ধুর অবিস্মরণীয় ভাষণ। পরেরদিন আমি রেডিওতে শুনেছি। দৈনিক পত্রিকায় সেই বিশাল জনারণ্যের ছবি দেখেছি।

২৫শে মার্চের কাল রাত্রির কথা আমি শুনেছি। জেনেছি কীভাবে নির্বিচারে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী রাতের অন্ধকারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের এবং ঢাকা শহরের নিরস্ত্র মানুষের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল দানবের মতো। ঘটিয়েছিল অযুত প্রাণহানি।

আমাদের বাড়ি জামালপুর মহকুমার মাদারগঞ্জ থানার উত্তর প্রান্তে। বাড়ি থেকে প্রায় দুই মাইল দূরে পশ্চিমে যমুনা নদী। নদী হতে একটা শাখা নদী গোবিন্দি চরের কাছে পশ্চিম থেকে পুবে প্রবাহিত হয়েছে। নদীটির অবস্থান আমাদের বাড়ি থেকে মাত্র এক মাইল উত্তরে। 

মে মাসে একদল মুক্তিযোদ্ধা আমাদের এলাকায় আগমন করল। তাদের হাতে থ্রি নট থ্রি রাইফেল, স্টেনগান ও গ্রেনেড। দলের সর্বকনিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধা আমাদের বাড়ির পাশের স্কুলের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। তিন চারদিন তারা ছিল স্কুলে। সারা দিনমান আমরা শিশুরা তাদের চারপাশে ঘোরাঘুরি করতাম। 

আমার সখ্য হয়েছিল সেই কনিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধার সাথে। সে ছিল আমাদের স্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষকের ছোট ভাই। তাকে নিয়ে আমার মুগ্ধতার শেষ ছিল না। তার হাতের স্টেনগানের গায়ে অনেকগুলো ছিদ্র ছিল। মনে মনে ভাবতাম এই ছিদ্রগুলো দিয়ে গুলি বের হলে এক সঙ্গে কতজন পাক হানাদার বাহিনীর সদস্য মৃত্যুবরণ করতে পারে?

আমাদের থানার দুই প্রান্তে ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের দুটো ক্যাম্প। প্রতি ক্যাম্পের জনবল ছিল এক কোম্পানি করে। একটা ক্যাম্প আমাদের বাড়ির নিকটে। এই কোম্পানির নাম ছিল আলম কোম্পানি। অন্য কোম্পানির অবস্থান মাদারগঞ্জ থানার দক্ষিণ প্রান্তে। খরকা বিলের পাশে। নাম বদি কোম্পানি। 

আলম কোম্পানির মুক্তিযোদ্ধারা ঝাড়কাটা নদীর দক্ষিণ তীর ঘেঁষে অনেকগুলো রাইফেল এবং এলএমজি ট্রেঞ্চ খনন করেছিল। লম্বা সারিতে দিগন্ত জুড়ে বিস্তৃত এই ট্রেঞ্চগুলোকে পাকিস্তানি হানাদারদের ভবিষ্যৎ কবর চিন্তা করে আমি সর্বক্ষণ আনন্দে শিহরিত হতাম।

বর্ষাকালের শেষের দিকে জামালপুর শহর থেকে পাকবাহিনী এলো। মেলান্দহ থেকে মাহমুদপুর বাজার পর্যন্ত রাস্তার পাশের সকল ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিলো। মুক্তিযোদ্ধারা ঝাড়কাটা নদীর দক্ষিণ পাড়ে প্রতিরক্ষা অবস্থান গ্রহণ করল। প্রাণভয়ে নদী সাঁতরে ওপারের  মানুষেরা চলে এলো আমাদের এলাকায়। পাকবাহিনী নদী পার না হয়েই  ফিরে গেল জামালপুরে।

আমার মনে আছে বর্ষার পর পর আমাদের পরিবারে আশ্রয় নিয়েছিল ফরিদপুর থেকে আগত এক অধ্যাপক পরিবার। সাথে তার  কিশোর বয়সী ভাই। নাম মানিক। উচ্ছ্বল এক তরুণ। আমার সাথে প্রবল বন্ধুত্ব হয়েছিল তার। 

শরৎকালে আমাদের বাড়ির কাচারিঘরে আশ্রয় নিলো  যুদ্ধাহত এক মুক্তিযোদ্ধা। উজ্জ্বল চোখের এক যুবক। কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা তাকে কাঁধে করে বহন করে আনল। তার চেহারা কিছুটা মনে থাকলেও নামটা মনে নেই। হয়তো কামালপুরের যুদ্ধে বা পয়লা ব্রিজের যুদ্ধে সে আহত হয়েছিল। 

৫/৬ মাস সে আমাদের বাড়িতে অবস্থান করেছিলো। তার ডান পায়ের হাঁটুর ওপরের ঊরুতে একটা বিরাট গোলাকৃতি গুলির ক্ষত ছিল। আমার সাথে তার সম্পর্কটা ছিল নিবিড় বন্ধুত্বের। ১৬ ডিসেম্বরের পর সে আমাদের বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল। আর কোনোদিন ফিরে আসেনি। 

আমাদের বাড়ির উঠোন থেকে উত্তরে তাকালে দূরে দিগন্তের ওপারে নীলের চেয়েও ঘন নীল একটা পাহাড়ের রিজলাইন দেখা যেত। শুধু শরৎ ও হেমন্তকালে। পাহাড়টির নাম গারো পাহাড়। শিশু হিসেবে বাস্তব পৃথিবীতে এটাই ছিল আমার প্রথম দেখা সবচেয়ে বিষ্ময়কর দৃশ্য। ঝাড়কাটা নদী, ঝিনাই নদী এবং ব্রহ্মপুত্র নদী পেরিয়ে তেপান্তরের পারে। আমার কাছে দৃশ্যটিকে মনে হতো অন্য কোনো পৃথিবীর অংশ।

গারো পাহাড়ের কাছের একটা জায়গার নাম ধানুয়া কামালপুর। জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত। এখানে পাকসেনাদের শক্তিশালী ঘাঁটি ও প্রতিরক্ষা অবস্থান ছিল। মুক্তিযোদ্ধাদের একটা বিশাল দলও এখানে কাজ করছিল। ১১ নং সেক্টরের অধীনে। সীমান্তবর্তী এই সেক্টরের সদর দপ্তর ছিল ভারতের মহেন্দ্রগঞ্জে। 

এই অঞ্চলে নিয়মিত মুক্তিবাহিনীর ৩ হাজার ও গণবাহিনীর ১৯ হাজারসহ মোট ২২ হাজার মুক্তিযোদ্ধা ছিল। ১৯৭১ সালের জুলাই মাস থেকে ২৮ নভেম্বর সময়কালে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে পাকবাহিনীর ১০ বার সম্মুখ যুদ্ধ হয়েছিল। 

১৯৭১ সালের ৩১ জুলাই তারিখে মুক্তিযোদ্ধারা কামালপুরের পাকিস্তানি প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপর আক্রমণ পরিচালনা করে। এটি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের দ্বারা পরিচালিত পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম কনভেনশনাল যুদ্ধ। মাত্র ৪ সপ্তাহের বেসিক ট্রেনিং করা তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিল কয়েকজন অকুতোভয় সামরিক অফিসারের নেতৃত্বে।

কামালপুরে পাকসেনাদের প্রতিরক্ষা অবস্থানের দায়িত্বে ছিলো ৩০ বালুচ রেজিমেন্টের একটা কোম্পানি। অবস্থানটি তৈরি করা হয়েছিলো শক্ত কংক্রিট দিয়ে। চারপাশে কাঁটাতারের বেড়া, মাইনফিল্ড এবং পাঞ্জি বিছানো হয়েছিলো। প্রতিরক্ষা অবস্থানের সামনের সকল গাছপালা কেটে পরিষ্কার করা হয়েছিলো যাতে ফিল্ড অব ফায়ার (Field of Fire) পেতে অসুবিধা না হয়। এর বাইরে ফিল্ড গান ও ৮১ মি.মি. মর্টারের ফায়ার দিয়ে অবস্থানটি সুরক্ষিত করা হয়েছিলো। 

মুক্তিযোদ্ধাদের ১ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের দুইটি কোম্পানিকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিলো এই অবস্থানটি দখল করার। ব্রাভো (বি) ও ডেলটা (ডি) কোম্পানি। ক্যাপ্টেন হাফিজ উদ্দিন আহমদ ও ক্যাপ্টেন সালাহ উদ্দিন ছিলেন যথাক্রমে কোম্পানিদ্বয়ের অধিনায়ক। আক্রমণের পূর্ব-প্রস্তুতি হিসেবে তারা এক রাতে পাকিস্তানিদের প্রতিরক্ষা অবস্থান রেকি করতে গেলে ক্যাপ্টেন সালাহ উদ্দিনকে পাকিস্তানি প্রতিরক্ষা অবস্থানের প্রহরী চ্যালেঞ্জ করে বসে। প্রতিক্রিয়া হিসেবে তিনি প্রহরীর ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়েন। শুরু হয় দুজনের মধ্যে মল্ল যুদ্ধ। পাক-প্রহরী পালিয়ে যাবার চেষ্টা করলে ডেলটা কোম্পানির সুবেদার আব্দুল হাই তাকে গুলি করে নিহত করেন। এই গোলাগুলিতে আরো একজন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। রেকি দল তাদের কাছ থেকে দুটো জি-৩ রাইফেল কেড়ে নিয়ে আসে। 

কিন্তু এর ফলে পাকিস্তানি প্রতিরক্ষা অবস্থান সতর্ক হয়ে যায়। প্রতিরক্ষা অবস্থানের ওপরে বড় ধরনের আক্রমণ হতে পারে ভেবে তারা সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ ও সতর্কতা বাড়িয়ে দেয়। অবস্থানকে দুর্ভেদ্য করে তোলে। ফলে রেকির মাত্র ৩দিন পর ৩১ জুলাই ১৯৭১ তারিখ রাতে মুক্তিবাহিনী আক্রমণ পরিচালনা করার সময়ে পাকিস্তানি প্রতিরক্ষা অবস্থানের সমন্বিত ফায়ারের মুখে পড়ে। ক্যাপ্টেন সালাহ উদ্দিনসহ ৩০ জন তরুণ মুক্তিযোদ্ধা শাহাদত বরণ করেন এবং ক্যাপ্টেন হাফিজ ও লেফটেন্যান্ট মান্নানসহ ৬৬ জন মুক্তিযোদ্ধা আহত হন।

নভেম্বরের শেষ সপ্তাহ অথবা ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ। আমাদের বাড়ির ওপর দিয়ে ভারতীয় বোমারু বিমান উড়ছে জোড়ায় জোড়ায়। উত্তরের গারোপাহাড় থেকে দক্ষিণের বঙ্গোপসাগরের দিকে। উজ্জ্বল আলোতে সেগুলোকে  উঠোনের আলোতে উড়ে যাওয়া ঘাস ফড়িঙের মতো মনে হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর পর মেঘের গর্জনের মতো শব্দ শোনা যাচ্ছে। অথচ আকাশে কোনো মেঘ নেই। আমি বিস্ময়াভিভূত।

ইতিহাস থেকে পরে আমি জেনেছি যে, নভেম্বরের শেষ দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ-প্রতি-আক্রমণে ভুগতে ভুগতে দুর্বল হয়ে গিয়েছিল কামালপুরের পাকিস্তানি প্রতিরক্ষা অবস্থান। এই সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে নিয়ে  আর্টিলারি ও সাঁজোয়া সহায়তা নিয়ে ভারতীয় বাহিনী আক্রমণ করে। ১০ দিনব্যাপী যুদ্ধের পর ৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় দুর্গে অবরুদ্ধ ৩১ বালুচ রেজিমেন্টের গ্যারিসন কমান্ডার আহসান মালিক খানসহ ১৬২ জন হানাদার সদস্য প্রতিরক্ষা অবস্থান থেকে সাদা পতাকা উড়িয়ে বেরিয়ে এসে মিত্র বাহিনী ও মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে আত্মসমর্পণ করে। বাংলার মাটিতে পাকিস্তানি নিয়মিত বাহিনীর এই ছিল প্রথম আত্মসমর্পণ!

১৯৭১ সনের ডিসেম্বর মাস। আমার চারপাশ ক্রমশ প্রকম্পিত হয়ে উঠছে হাজার হাজার মানুষের ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে। অপারেশন লাইটনিং ক্যাম্পেইন (The Lightning Campaign) নামের মাত্র ১২ দিনের যুদ্ধে মিত্রবাহিনী এবং মুক্তিযোদ্ধারা দ্রুত এগিয়ে আসে ঢাকার দিকে।

৬ ডিসেম্বর তারিখে মুক্ত হয় দেওয়ানগঞ্জ, বকশীগঞ্জ ও শেরপুর।

১০ ডিসেম্বর তারিখে মুক্ত হয় জামালপুর।

১১ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে ঢাকা হতে অদূরে টাংগাইলের শ্রীপুরে কাদেরিয়া বাহিনীর সহায়তায় মিত্রবাহিনীর বিমান থেকে সাত শতাধিক প্যারাট্রুপার অবতরণ করে।

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল। বিকেলে রমনার রেসকোর্স ময়দান লোকে লোকারণ্য। বিকেল তিন ঘটিকায় পাকিস্তানি  হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করে। ৯ মাসের যুদ্ধের শেষ হয়। 

এইদিন গোধূলির সময়ে রক্তের চেয়েও লাল রঙের এক সূর্যকে দেখা গেল। ৩০ লক্ষ শহীদের রক্ত আর অযুত মা বোনের শ্লীলতাহানির বিনিময়ে আকাশ উজ্জ্বল করে থাকা বিজয়ের সূর্য।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা

আরও পড়ুন
অসম্পাদিত বিভাগের সর্বাধিক পঠিত