ঢাকা, ০৩ ডিসেম্বর, ২০২৪
সর্বশেষ:

‘ময়ূর সিংহাসন’

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১২:০৫, ২৬ নভেম্বর ২০১৮  

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

 

প্রিয়তমা পত্নী মমতাজ মহলের স্মৃতিকে চিরভাস্বর অম্লান করে ধরে রাখার জন্য বিশ্বখ্যাত তাজমহল নির্মাণ করেন সম্রাট শাহজাহান। 

তাজমহলের স্থাপত্য সৌকর্য শতাব্দীর পর শতাব্দী মানুষের মনে একই রকম বিস্ময় জাগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু বিখ্যাত ও আলোচিত ময়ূর সিংহাসন সম্পর্কে না জানলে যেন সম্রাট শাহজাহানকে জানা অনেকটাই অসম্পূর্ণ থেকে যায়।

 

শাহজাহানের শিল্পানুরাগের আরো একটি বিখ্যাত নিদর্শন হল জগৎ বিখ্যাত এই ময়ূর সিংহাসন। এটিকে বিশ্বের সবচেয়ে দামি সিংহাসন মনে করা হয়। সেজন্য ইতিহাসের পাতায় অন্য সব সিংহাসন ছাপিয়ে এটি আলোচিত ও বিখ্যাত হয়ে উঠেছে। মোগল স্থাপত্যের এই অনুপম নিদর্শনটি তৈরি হয় শিল্পের সমঝদার ও মুঘল সাম্রাজ্যের সোনার অলঙ্কার তৈরির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রধান বেবাদল খাঁ'র সরাসরি তত্ত্বাবধানে। 

বেবাদল খাঁর তত্ত্বাবধানে ১৬২৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৬৩৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় আট বছর তৎকালীণ আট কোটি টাকা ব্যয়ে এটি নির্মিত হয়। বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে সে সময়ে আগ্রার তাজমহলের চেয়েও দ্বিগুণ অর্থ ব্যয়ে শাহজাহান নির্মাণ করেন এই অপূর্ব সিংহাসনটি। ফারসিতে একে বলা হতো ‘তখত-ই-তাউস'। তখত মানে সিংহাসন, আর তাউস শব্দের অর্থ হল ময়ূর। কিন্তু সিংহাসনের নাম ‘ময়ূর সিংহাসন’ কেন? কারণ সিংহাসনের পেছনে অনিন্দ্যসুন্দর পেখম ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকা দু’টি ময়ূরের ছবি ছিল।

ময়ূর সিংহাসন ছিল মূল্যবান স্বর্ণ, হীরা ও দূর্লভ মরকত মনি খচিত। সিংহাসনের চারটি পায়া নিরেট স্বর্ণ দ্বারা নির্মিত ছিল এবং বারোটি মরকত মনি স্তম্ভের ওপর চন্দ্রতাপ ছাদ আচ্ছাদন করা হয়। ছাদের চারদিকে মিনা করা মণি মুক্তা বসানো ছিল। এর ভেতরের দিকের সবটাই মহামূল্যবান চুন্নি ও পান্না দ্বারা মুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। প্রত্যেক স্তম্ভের মাথায় মণি-মাণিক্য খচিত এক জোড়া ময়ূর মুখোমুখি বসানো হয়েছিল এবং প্রতি জোড়া ময়ূরের মধ্যস্থলে একেকটি মণি মাণিক্য নির্মিত গাছ এমনভাবে স্থাপন করা হয়েছিল যেন ময়ূর দুটি ঠুকরে গাছের ফল খাচ্ছে এরূপ প্রতীয়মান হয়।

পুরো সিংহাসনে অসংখ্যা নকশার মধ্যে ফাঁকা অংশটুকু কারুকার্য করা হয় ক্ষুদ্রাকৃতির হীরা দিয়ে। হীরা পান্না দ্বারা সুসজ্জিত তিনটি সিঁড়ির সাহায্যে ওঠানামার ব্যবস্থা ছিল। সিংহাসনের অপরের চাঁদোয়ার চারকোণে বসানো হয়েছিল সারিবদ্ধ মুক্তা। চাঁদোয়াটির নিচেও ছিল হীরা আর মুক্তার বাহারি নকশা। রকমারি জহরত দিয়ে সাজানো ময়ূরগুলোর লেজ ছিল নীল রঙের মণি দিয়ে তৈরি। এক একটি বিরাট আকারের চুনি বসানো ছিল ময়ূরের বুকে। সেখান থেকে ৫০ ক্যারটের একটি হলুদ রঙের মুক্তা ঝুলে থাকতো। সিংহাসনটিতে বসবার জন্য ভিন্ন ভিন্ন দিকে অগণিত মনি মুক্তা শোভা পেত।

১৫৮৭ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে পারস্যের মহামান্য সম্রাট আব্বাস তৎকালীন এক লাখ টাকা মূল্যের একটা হিরা বাদশাহকে উপহার দেন। সম্রাট শাহজাহান পিতার এই উপহার প্রাপ্ত অত্যন্ত দামি হীরাটিও সিংহাসনে যোগ করেন। এই ময়ূর সিংহাসনের নির্মাণ ব্যয় নিয়ে দুটি তথ্য পাওয়া যায়। সেকালে এটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছিল ৮ কোটি টাকা, যা ইতিপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। অন্যদিকে তৎকালীন ইউরোপীয় পর্যটক টাভার্নিয়ার উল্লেখ করেছেন, এই শিল্পমণ্ডিত বহুমূল্য রত্নখচিত সিংহাসনটি নির্মাণে ব্যবহৃত হয়েছিল পাঁচ কোটি টাকার হীরা-মুক্তা-পান্না, ৯০ লাখ টাকার জহরত, ২০ লাখ টাকা মূল্যের ১ লাখ তোলা ওজনের স্বর্ণ।

এই মহামূল্যবান ময়ূর সিংহাসনটি ১৭৩৯ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির সম্রাট মোহাম্মদ শাহের শাসনামলে, পারস্য সম্রাট নাদির শাহের ভারতবর্ষ অভিযানকালে লুণ্ঠিত হয়। এর অবর্ণনীয় সৌন্দর্যৈ পাগলপারা হয়ে নাদির শাহ সিংহাসনটি সঙ্গে নিয়ে যান নিজ দেশ পারস্যে (বর্তমান ইরান)। পরে এই ময়ূর সিংহাসনের জন্য তার প্রতিপক্ষের কাছে নিদারুণভাবে খুন হন তিনি। ১৭৪৭ সালে নাদির শাহ আততায়ীর হাতে নিহত হন। এরপরই আসল ময়ূর সিংহাসনটি হারিয়ে যায়। নাদির শাহের মৃত্যুর ফলে সৃষ্ট গোলযোগের মধ্যে হয় এটি চুরি হয়ে গিয়েছিল, নয়তো এর বিভিন্ন অংশ খুলে আলাদা করা হয়েছিল। এটাও ধারণা করা হয়, সিংহাসনটি হয়তো ওসমানীয় সাম্রাজ্যের সুলতানদেরকে দেয়া হয়েছিল। 

যা-ই হোক, পরবর্তী ইতিহাসে পারস্য সাম্রাজ্যের সিংহাসনগুলোকে ভুলক্রমে ‘ময়ূর সিংহাসন’ নামে ডাকা হতো, যেগুলোর সঙ্গে আসল ময়ূর সিংহাসনের মিল ছিল না। আবার ১৮১২ সালে আলী শাহ কাজার কিংবা ১৮৩৬ সালে মোহাম্মদ শাহ কাজারের তৈরি সিংহাসনের সঙ্গে মুঘল চিত্রকলাতে প্রাপ্ত আসল ময়ূর সিংহাসনের কিছুটা মিল দেখা যায়। ইতিহাসবিদদের ধারণা, হয়তো মূল ময়ূর সিংহাসনের অংশ বিশেষ এগুলো তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছিল।

আজ ভারতে কেন পারস্যেও নেই এই সিংহাসনটি। অনেক রাজার রাজত্বে হাত বদল হয়ে কালের গর্ভে ধ্বংস হয়ে গেছে। বিশ্বখ্যাত কোহিনূর হীরা ময়ূর সিংহাসনে বসানো ছিল। পরে ব্রিটিশের হাতে কোহিনূর হীরাটি চলে যায়। এক সময় ইংল্যান্ডের রানী মহারানী ভিক্টোরিয়ার মুকুটে সেটা শোভা পায়। বংশপরম্পরায় ইংল্যান্ডের বর্তমান রানী মহারানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের মুকুটেও শোভা পেয়েছিল এটি।

প্রাচীনকালের সুন্দরী কুমারীর মতো ময়ূর সিংহাসনে স্থান পাওয়া দূর্লভ রত্ন বিখ্যাত কোহিনূর হীরাটিও বিভিন্ন রাজা বাদশাহ ও শাসকের হাত ঘুরে এখন স্থান পেয়েছে ইংল্যান্ডের টাওয়ার অফ লন্ডনে।

নিউজওয়ান২৪/আরএডব্লিউ