ঢাকা, ৩০ অক্টোবর, ২০২৪
সর্বশেষ:

জন্মদিন পালন: ইসলামী শরিয়ত কী বলে?

ধর্ম ডেস্ক

প্রকাশিত: ১১:৫০, ২৮ অক্টোবর ২০২৪  

ছবি অন্তর্জাল

ছবি অন্তর্জাল


বর্তমানে জন্মদিন পালনের প্রবণতা বিশ্বজুড়ে বেড়েছে ব্যাপকহারে। জন্মদিন পালন করেন না, অথবা জন্মদিনে বন্ধু-বান্ধব, পরিচিতজনের কাছ থেকে শুভেচ্ছা বার্তা ও গিফট পান না, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া একটু মুশকিলই বটে!

এদিকে, জন্মদিনের উৎসব-আয়োজন থেকে কেউ দূরে সরে থাকতে চাইলেও শুভাকাঙ্খীদের আন্তরিকতায় তা সম্ভব হয়ে উঠে না অনেক সময়। তবে ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতে আগ্রহীদের এই প্রবণতা থেকে বেঁচে থাকা এবং থাকার চেষ্টা করা উচিত।

কারণ, ইসলামী আইন ও ফেকাহশাস্ত্রবিদেরা জন্মদিন পালনকে বৈধ বলেন না। তাদের মতে, জন্মদিন পালন করা জায়েজ নয়। কারণ, একজন মুসলিম-মুমিনের যেকোনো কাজ বা পদক্ষেপের আগে এ বিষয়ে ধর্মীয় বিধান জেনে রাখা জরুরি। বিশ্বনবী রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম এ বিষয়ে কী বলেছেন, কী করেছেন তা জানা জরুরি।

আর রাসূলুল্লাহ (সা.) ও সাহাবিদের জীবনী দেখলে জন্মদিন পালনের কোনো নজির পাওয়া যায় না। ইসলামে জন্মদিন পালনের কোনো নিয়ম নেই। ইসলামে যদি জন্ম দিন পালনের নিয়ম থাকত, তাহলে সাহাবায়ে কেরাম (রা.), তাবেয়ি, তাবে তাবেইনদের থেকে এটি পালনের প্রমাণ মিলত। তারা জীবনে কখনো জন্মদিন পালন করেননি, এমনকি কারো কারো জন্মসন জানা গেলেও কোন মাসের কোন তারিখে জন্মগ্রহণ করেছেন তা অবধি জানা যায়নি।

আমাদের প্রিয়নবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.) রবিউল আওয়াল মাসের কত তারিখে জন্মগ্রহণ করেছেন এটা নিয়েও রয়েছে মতভেদ। বিধায় জন্মদিন পালন জায়েজ বলেন না আলেমরা।

আলেমদের মতে, জন্মদিন পালন বিজাতীয় কালচারের অন্তর্ভুক্ত। আর রাসূলুল্লাহ (সা.) বিজাতীয় অনুকরণে নিরুৎসাহিত করছেন। এক হাদিসে রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি বিজাতির সাদৃশ্য অবলম্বন করে, সে তাদের দলভুক্ত হিসেবে গণ্য হবে’। (আবু দাউদ, হাদিস: ৪০৩)

অন্যদিকে জন্মদিনকে কেন্দ্র করে কখনো কখনো অপচয় ও অপব্যয় করতে দেখা যায়। ইসলামে অপচয় ও অপব্যয় নিষিদ্ধ। অপচয় নিষিদ্ধ করে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘তোমরা আহার করো ও পান করো। কিন্তু অপচয় করো না...’। (সূরা: আরাফ, আয়াত: ৩১)

একজন মুমিন মুসলমানকে মনে রাখতে হবে তার প্রতিটি পদক্ষেপের হিসাব নেবেন আল্লাহ তাআলা। হাশরের মাঠে পৃথিবীতে করা প্রত্যেকটি আমলের হিসাব দিয়েই পার পেতে হবে। হাশরের মাঠে আল্লাহর সামনে যে প্রশ্নটির মুখোমুখি হতে হবে সবাইকে তাহলো— পৃথিবীর জীবন কীভাবে কাটিয়েছে, কীভাবে জীবনযাপন করেছে। এজন্য প্রত্যেক কাজ ভেবে চিন্তে করতে হবে।

আমাদের মনে রাখতে হবে যে, সংস্কৃতি হলো রুচিসম্মত, মার্জিত যা পুরো সমাজের জন্য গ্রহণযোগ্য। আর অপসংস্কৃতি এর বিপরীত। একটি অপসংস্কৃতি শুধু একটি সমাজকেই বিনষ্ট করে না; বরং পুরো জাতির জন্যই হুমকিস্বরূপ। একটি শিশু যখন তার পরিবার থেকে এরকম কিছু দেখে দেখে বড় হবে তখন সেও এক সময় জন্মদিন পালনে অভ্যস্ত হবে। আধুনিক মুসলিম সমাজে এই অপসংস্কৃতিকে ঘিরে শুধু কেক কাটাই সীমাবদ্ধ রাখেনি, এর সঙ্গে নাচ, গান, অবাধে মেলামেশা আরো কত কী!

এদিকে জন্মদিন পালন আনুষ্ঠানিকতা আমরা নতুন মনে করলেও এর ইতিহাস বেশ পুরনো। জন্মদিন, বেশির ভাগ মানুষের কাছে প্রতি বছর অনেক প্রতীক্ষার একটি দিন। জন্মদিন উপলক্ষে হরেক রকমের কেকের দেখাও মেলে আজকাল। অনেক জন্মদিনের অনুষ্ঠান তো বিয়ের অনুষ্ঠানের থেকেও ধুমধাম হতে দেখা যায়।

লিখিতভাবে জন্মদিনের কথা প্রথম জানা যায়, বাইবেলের জেনেসিস অধ্যায় থেকে। মিসরের ফারাওদের জন্মদিন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি দিন ছিল মিসরে। বাইবেলে জন্মদিনের কথা বলা থাকলেও সেটি জন্মের দিন নাকি সিংহাসনে বসার দিন। এ নিয়ে ইজিপ্টোলজিস্টদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। প্রাচীন মিসরে ফারাওদেরকে ঈশ্বর মনে করা হতো আর সিংহাসনে বসার দিনটিকে মনে করা হতো তাদের মানুষ থেকে ঈশ্বরে রূপান্তরের দিন। তাই ঠিক কোন দিনটির কথা বলা হচ্ছে সেটি পরিষ্কার বোঝা না গেলেও ফারাওয়ের জন্মের দিন কিংবা ‘ঈশ্বরে রূপান্তরের দিনটিকে’ বেশ ধুমধামের সঙ্গেই পালন করা হতো। বাইবেলে বর্ণিত এই ফারাও ছিলেন ইউসুফ (আ.) এর সময়ের ফারাও, যে সময় ইউসুফ (আ.)-কে যৌন নির্যাতনের মিথ্যা অভিযোগে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। বাইবেলের বর্ণনা থেকে জানা যায়, ‘তৃতীয় দিনটি ছিল ফেরাউনের জন্মদিন। ফেরাউন তার সব কর্মকর্তার জন্য ভোজের আয়োজন করেন। ফেরাউন তার মদ-পরিবেশক ও রুটি প্রস্তুতকারককে ক্ষমা করে দিলেন’। (ওল্ড টেস্টামেন্ট, জেনেসিস: ৪০-২০)

আর ইদানীং জন্মদিন পালনে, যে কেক কাটার ধুমধাম আয়োজনে ভরপুর তা ইউরোপের একটি সংস্কৃতি থেকে আসা। বর্তমান সময়ে এসে আমরা এটিকে সংস্কৃতি বলব নাকি অপসংস্কৃতি! যেহেতু আমরা সভ্য দাবি করে বসি।

ইউরোপে জন্মদিন পালন শুরু হয় গ্রিক দেবী আর্টেমিসের জন্মদিনে চাঁদ আকৃতির কেক উৎসর্গ করে। ঠিক কিভাবে জন্মদিনের প্রথা গ্রিসে গেছে তা জানা না গেলেও ধারণা করা হয়, মিসরীয়দের ফারাওয়ের জন্মদিন পালন করার রীতি অনুসরণ করে গ্রিকরা তাদের দেব-দেবীদের জন্মদিন পালন করা শুরু করে। চন্দ্রদেবী আর্টেমিসের জন্মদিনের কেকে মোমবাতি জ্বালিয়ে কেকটিকে উজ্জ্বল করার বুদ্ধিও গ্রিকদের মাথা থেকেই এসেছিল। সুস্পষ্টভাবে বলাই যায়, চন্দ্রদেবীর সম্মানার্থে চাঁদের আলোর মতো আলো তৈরি করার জন্যই কেকের সঙ্গে মোমবাতি জ্বালানোর বুদ্ধিটি তাদের মাথায় আসে। সুতরাং আমাদের সভ্য জাতির জন্য কতটুকু বোধগম্য হবে তা আদৌ জানা নেই।

ভূমধ্যসাগরের বাইরে পারস্যে সাধারণ জনগণের জন্মদিনের কথা হেরোডোটাসের লেখা থেকে জানা যায়। ধনীরা তাদের জন্মদিনে বেশ বড়সড় ভূরিভোজের আয়োজন করত পারস্যে। প্রাচীন ভারত কিংবা চীনে সাধারণ জনগণের জন্মদিনে পালনের তথ্য খুব একটা পাওয়া যায় না। তবে হিন্দু দেবতা কৃষ্ণের জন্মদিন উপলক্ষে জন্মাষ্টমী বেশ অনেক বছর ধরেই ভারতবর্ষে প্রচলিত রয়েছে। কিন্তু ঘুরেফিরে জন্মদিন সে সময় দেব-দেবী কিংবা রাজা-বাদশাহদের জন্মদিনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল মূলত।

ধর্মীয় বেড়াজালের বাইরে প্রথম জন্মদিনের কথা জানা যায় রোমে। রোমে সাধারণ জনগণ পরিবার ও বন্ধুদের জন্য জন্মদিনের পার্টি শুরু করে। এমনকি বিশেষ ক্ষমতাশালী ও সম্মানিত ব্যক্তিদের জন্মদিনে সরকারিভাবে ছুটিও চালু হয়। তবে জন্মদিন পালন শুধু পুরুষদের জন্যই ছিল। নারীদের জন্মদিন পালনের কোনো রীতি তখনো চালু হয়নি। ৫০তম জন্মদিন পালনের জন্য ময়দা, মধু, জলপাই তেল ও বিশেষ পনির দিয়ে বিশেষ কেক বানানো হতো।

এদিকে প্যাগান সমাজে জন্মদিন পালনের রীতি থাকলেও সেমেটিক সমাজে জন্মদিন মোটেও স্বাভাবিক নিয়ম ছিল না; বরং প্যাগানদের থেকে উৎপত্তি হওয়ার কারণে ইহুদি ও খ্রিষ্টানরা প্রথমদিকে জন্মদিন পালনকে শয়তানের রীতি হিসেবে মনে করত। তবে খ্রিষ্টানদের ধ্যানধারণা পাল্টাতে থাকে চতুর্থ শতাব্দীর পর থেকে। প্রথম দিকে কোনো নিয়ম না থাকলেও চতুর্থ শতাব্দীর পর থেকে ঈসা (আ.) এর জন্মদিন পালন শুরু করে খ্রিষ্টানরা। এর ফলে খ্রিষ্টান চার্চগুলো জন্মদিন পালনে অভ্যস্ত হয়ে উঠতে থাকে। প্রথম দিকে ধর্মীয় চরিত্রগুলোর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষও কেউ কেউ জন্মদিন পালন শুরু করে। বর্তমানে ক্রিসমাস পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠানগুলোর একটিতে পরিণত হয়েছে।

এবার জেনে নেয়া ভালো, কারা এই প্যাগান জাতি?

প্যাগানরা একাধিক ঈশ্বরে বিশ্বাস করত। অবশ্য আব্রাহামিক ধর্মগুলোর মতো তাদের স্বর্গ বা নরকের কোনো ধারণা ছিল না বা তারা এগুলোতে বিশ্বাস করত না। তবে একটি জায়গায় হিন্দু ধর্মের সঙ্গে বেশ মিল পাওয়া যায় সেটি হলো- পুনর্জন্ম। প্যাগানরাও পুনর্জন্মে বিশ্বাসী ছিল।

ইউরোপিয়ানদের হাত ধরে তাদের মতো জন্মদিন পালন ছড়িয়ে পড়তে থাকে পুরো পৃথিবীতে। যেসব সমাজে জন্মদিন পালনে কোনো প্রথা ছিল না তারাও শুরু করে জন্মদিন পালন। তবে জন্মদিন দীর্ঘদিন শুধু ধনীরাই পালন করত। অষ্টাদশ শতাব্দীতে জার্মানিতে কেক ও মোমবাতি দিয়ে শিশুদের জন্মদিন পালন শুরু হয়। শিশুদের মোমবাতি দেওয়া হতো তাদের যততম জন্মদিন ততটির থেকে একটি বেশি। এই বেশি মোমবাতিটি দিয়ে তাদের আরো এক বছর আয়ুর আশা করা হতো। মোমবাতি নিভিয়ে জন্মদিন পালনের রীতিও সে সময় থেকেই চালু হয়।


সাধারণ মানুষের মধ্যে কেক কেটে জন্মদিন পালনের প্রথা শুরু হয় শিল্প বিপ্লবের ফলে কেক তৈরির উপকরণগুলো সহজলভ্য হওয়ায়। আধুনিক যন্ত্রের সাহায্যে স্বল্প সময়ে অনেক কেক বানানো সম্ভব হতো, দামও তুলনামূলক কম থাকত। ফলে ধনীদের পাশাপাশি স্বল্প আয়ের মানুষও তাদের জন্মদিন পালন শুরু করে।

জন্মদিনের বিখ্যাত গান ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ’ আসলে প্যাটি হিল ও ম্যাড্রেড হিলের সুর করা ‘গুড মর্নিং টু অল’ গানের সুর। ১৮৯৩ সালে সুর করার পর সুরটি আমেরিকায় বেশ জনপ্রিয় হয়। অনেক জন্মদিনের অনুষ্ঠানে এ সুরের সঙ্গে ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ’ কথা জুড়ে দেন প্যাটি হিল। আর এভাবেই ভিন্ন একটি গানের সুর পৃথিবীজুড়ে বিখ্যাত হয়ে যায় জন্মদিনের গানের সঙ্গে।

মজার ব্যাপার- ২০১৫ সালের আগ পর্যন্ত ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ’ গানটি ছিল কপিরাইট করা! অর্থাৎ বাণিজ্যিকভাবে এ গানটি ব্যবহার করতে হলে আপনাকে অর্থ দিতে হতো! এ গানটি থেকে মিলিয়ন ডলার ব্যবসাও হয়ে গেছে। তবে ২০১৫ সালে আমেরিকার একজন বিচারক এ কপিরাইটটিকে অবৈধ ঘোষণা করলে কপিরাইটেড অধিকার উঠে যায় গানটি থেকে।

একসময় যে জন্মদিন ছিল শুধু দেব-দেবীদের জন্য, সেই জন্মদিন আজ ধনী-গরিব নির্বিশেষে সবাই পালন করে। আর আফসোসের বিষয় হলো- মুসলিম সমাজও এই তোপের মুখ থেকে বের হতে পারেনি। দিন যত গড়াচ্ছে ততই জন্মদিন প্রভাব আমাদের ভেতর বিস্তার লাভ করছে। মুসলিম হিসেবে আমাদেরও সচেতন হওয়া দরকার। আমরা পরিবর্তন হয়েছি কিন্তু পরিবর্তন শব্দটি শুধু নামেই। জন্মদিন পালন মুসলিমদের জন্য শুধু অপসংস্কৃতি নয়; বরং এটি আমাদের জন্য অভিশাপ হয়ে দাঁড়াবে। এতে শয়তানের ধোঁকা তো রয়েছে, সঙ্গে আমরাও সেই ধোঁকার ফাঁদে পড়ে অপচয় করছি। অপচয় শুধু নিজের জন্যই ধ্বংস ডেকে আনে না; বরং এটি পরিবার থেকে সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতি।

ইয়া আল্লাহ! জীবনযাপনে আমাদের সবাইকে সঠিক বুঝ দান করুন। এবং জন্মদিন নামক এমন ধোকাময়  অপসংস্কৃতি থেকে সব মুসলিম উম্মাহকে হেফাজত করুন। আমিন।

NewsOne24.Com/আরএডব্লিউ